ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার | Right to Religious Freedom of Indian Constitution

ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার | Right to Religious Freedom of Indian Constitution

■ প্রশ্ন:- ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ব্যাখ্যা করো। এই অধিকারের সীমাবদ্ধতা কি কি? (Right to Religious Freedom of Indian Constitution).

উত্তর:- ভারতীয় অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা:- ভারতীয় অর্থে ধর্ম-নিরপেক্ষতা বলতে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা বা ধর্মবিরোধিতা বোঝায় না। বলা হয় যে, রাষ্ট্র যাবতীয় ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও ধর্মবিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবে। অর্থাৎ ভারতে রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। রাষ্ট্র যে-কোন ধর্মের সংস্রব এড়িয়ে চলবে। কোন ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না। রাষ্ট্র ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করবে এবং মানুষকে ধর্মীয় বিবেচনা ছাড়াই কেবল মানুষ হিসাবে গণ্য করবে।

রাষ্ট্রের কাজকর্ম মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে মানুষের ধর্ম বা বিশ্বাসকে নিয়ে নয়। ধর্মবিশ্বাস মানুষের সম্পূর্ণ নিজস্ব ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলবে। জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল সংবিধানে স্বীকৃত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার। ভার সংবিধানের ২৫-২৮ এই চারটি অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রদান করা হয়েছে।

■ ব্যক্তির ধর্মের স্বাধীনতা:- সংবিধানের ২৫ ধারা অনুসারে সকল ব্যক্তিই সমানভাবে বিবেকের স্বাধীনতা অনুসারে ধর্মস্বীকার, ধর্মাচরণ এবং ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করবে। ব্যক্তি তার বিবেক অনুসারে ধর্মমত অবলম্বন করার অধিকার ছাড়াও, ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করার এবং ধর্মীয় মতামত প্রচার করার অধিকারও ভোগ করে রতিলাল বনাম মুম্বাই (বোম্বাই) রাজ্যসরকার, ১৯৫৪)। রাষ্ট্র সাধারণত কোন ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু কোন বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট কোন ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কিনা আদালত তা নির্ধারণ করতে পারবে (হানফি কুরেশি বনাম বিহার রাজ্যসরকার, ১৯৫৮)। শিখগণ তাদের ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কৃপাণ ধারণ ও বহন করতে পারবে।

ধর্মীয় স্বাধীনতা অবাধ নয়ঃ এই অধিকারটি অবাধ বা নিরঙ্কুশ নয়। জনশৃঙ্খলা, সদাচার, জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে রাষ্ট্র এই অধিকারটির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। তা ছাড়া, রাষ্ট্র ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত যে-কোন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বৈত্তিক (Financial) বা ধর্মনিরপেক্ষতা (Secular) সম্পর্কিত কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার সামাজিক কল্যাণ ও সংস্কার সাধনের জন্যও ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্র বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। সংবিধানের ২৫ (২) ধারা অনুসারে প্রতিনিধিমূলক হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠানগুলিকে সকল হিন্দুদের জন্য উন্মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারবে। হিন্দু বলতে শিখ, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও বোঝাবে। সম্প্রতি এ বিষয়ে শিখদের অকালি গোষ্ঠী ভিন্ন দাবি ঘোষণা করেছে।

■ ধর্মপ্রচারের অধিকার অত্যন্ত উদার:- অন্য কোন দেশের সংবিধানে ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়নি। গণপরিষদ এক্ষেত্রে অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছে। এই অধিকার ধর্মান্তরীকরণের (Conversion) কাজেও লাগান যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতির আশংকা আছে। এই আশংকা অমূলক নয়। যেমন বর্তমানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কোন কোন মিশনারী সম্প্রদায়ের কাজকর্মের উপর আরোপিত সরকারী নিয়ন্ত্রণ থেকেই এ কথা প্রমাণিত।

■ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার:- বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়কেও সংবিধানে কতকগুলি বিষয়ে অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৬ ধারা অনুসারে প্রত্যেক ধর্মসম্প্রদায় বা গোষ্ঠী-

● (১) ধর্ম ও দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে,

● (২) নিজস্ব ধর্মবিষয়ক কার্যতত্ত্বাবধান করতে পারবে,

● (৩) এই সম্পত্তি আইন অনুযায়ী পরিচালনা করতে পারবে। তবে রাষ্ট্র জনশৃঙ্খলা, সদাচার ও জনস্বাস্থ্যের কারণে ধর্মসম্প্রদায়ের এই অধিকারগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোন ধর্মসম্প্রদায় ‘তত্ত্বাবধানের’ অধিকারের অজুহাতে কোন সভ্যকে একঘরে বা ধর্মসম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করতে পারে না (তাহের বনাম তায়ে ভাই ১৯৩৫)।

■ বিশেষ ধর্মের উপর কর আরোপ নিষিদ্ধ:- ধর্ম বিষয়ে নিরপেক্ষতাকে নিশ্চিত করার জন্য এবং এক ধর্মসম্প্রদায়ের অন্যায় অত্যাচার থেকে অন্য সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য সংবিধানের ২৭ ধারায় কিছু নির্দেশ আছে। বলা হয়েছে যে-কোন বিশেষ ধর্ম বা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রসার বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোন ব্যক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা সংবিধানের ২৮ ধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাদান সম্পর্কে কতকগুলি বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে-

● (ক) পুরোপুরি সরকারী অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

● (খ) সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা আংশিকভাবে সরকারী অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের নিজেদের এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের সম্মতিসাপেক্ষে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে।

● (৩) কোন দাতা বা অছি কর্তৃক ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হলেও সেখানে বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে।

২৫-২৮ ধারার কথা বাদ দিলেও সংবিধানের অন্যান্য অংশেও ধর্মীয় অধিকারের উল্লেখ দেখা যায়। প্রস্তাবনায় চিন্তা, বাক্য, বিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতার কথা বলা আছে। ১৪ ধারায় আইনের চক্ষে সকলের সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। ১৫ ও ১৬ ধারায় কেবল ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে শ্রেণীবিভাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৭ ধারায় অস্পৃশ্যতাকে অবলুপ্ত করা হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণও এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ভারতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে যে-কোন রাজনৈতিক পদে নির্বাচিত করার এবং নির্বাচিত হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানদের মধ্যে থেকে দু’বার ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার সাফল্যের এমন নজির পৃথিবীর অন্য কোন দেশে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

তাছাড়া, ১৯৭৬ সালের ৪২ -তম সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে কেবলমাত্র সাংবিধানিক বা আইনগত ব্যবস্থাদির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার মনোভাব বিশেষভাবে দরকার। তা না হলে ভারতের জটিল সমাজব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা সম্ভব হবে না।