ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিসমূহ | Directive Principles of Indian Constitution

ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিসমূহ | Directive Principles of Indian Constitution

■ প্রশ্ন:- ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিসমূহের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো। মৌলিক অধিকারের সঙ্গে এর পার্থক্য উল্লেখ করো। এই নীতিসমূহকে সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করার তাৎপর্য কি? (Directive Principles of Indian Constitution).

উত্তর:- নির্দেশমূলক নীতি:- আধুনিক রাষ্ট্র কেবলমাত্র পুলিশী রাষ্ট্র নয়, জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্র। তাই বর্তমানে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিজীবনের পূর্ণবিকাশের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা। এ বিষয়ে মিল, বেন্থাম প্রমুখ উদারনৈতিকের প্রভাব সুস্পষ্ট। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কতকগুলি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মৌলিক নীতি সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই নীতিগুলিকে নির্দেশ হিসাবে মেনে চলবে। এই কারণে নীতিগুলিকে ‘রাষ্ট্রের কার্যে নির্দেশমূলক নীতি’ বলা হয়।

প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য নির্দেশমূলক নীতির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নির্দেশমূলক নীতিগুলি বিভিন্ন উৎস থেকে উদ্ভূত। গান্ধীজির চিন্তাধারা এবং হিন্দুধর্মের আদর্শ এক্ষেত্রে অন্যতম উৎস বিশেষ।

আম্বেদকরের মতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে গভর্নর ও গভর্নর-জেনারেলদের জন্য লিপিবদ্ধ ‘নির্দেশাবলী’ (Instrument of In structions) হল বর্তমান সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির প্রকৃত উত্তরসূরী। সপ্ৰু কমিটি (১৯৪৫) -র প্রতিবেদন অনুসারে নির্দেশমূলক নীতিগুলি সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছে। আয়ারল্যাণ্ডের সংবিধান (১৮৩৭) -ও এক্ষেত্রে গণপরিষদকে প্রভাবিত করেছে। এই ধরনের নির্দেশমূলক নীতি প্রজাতন্ত্রী স্পেনের সংবিধানে প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল। ভারতীয় সংবিধানের উদ্দেশ্য হল এক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই সমাজে কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের মৌলিক অধিকারগুলি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি।

মৌলিক অধিকারসমূহের এই ফাঁক পূরণ করার জন্য নীতিগুলির প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য নীতিগুলি কেন্দ্র, রাজ্য এবং সকল স্থানীয় আইন ও শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অবশ্য পালনীয় নির্দেশ হিসাবে গণ্য হবে। এগুলি হল শাসন পরিচালনা ক্ষেত্রে মৌলিক নীতি। মৌলিক অধিকারের সঙ্গে পার্থক্য

■ প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য:- নির্দেশমূলক নীতিগুলি অসংরক্ষিত অধিকার হিসাবে গণ্য হয়। আর মৌলিক অধিকারগুলি হল সংরক্ষিত অধিকার। তাই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে পার্থক্যের ভিত্তিতে নীতিগুলির বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যগত বিচারে এই দু’ধরনের অধিকারের মধ্যে গভীর যোগাযোগ বর্তমান। উভয়েরই উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। অন্যান্য ক্ষেত্রে কিন্তু উভয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পার্থক্য আছে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের জন্য দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আলোচনা করা দরকার। একটি হল আইনগত এবং দ্বিতীয়টি হল সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক; প্রথমটি সংকীর্ণ এবং দ্বিতীয়টি ব্যাপক।

● (১) মৌলিক অধিকারগুলি হল রাজনৈতিক গণতন্ত্র রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের উপর নেতিবাচক নিষেধাজ্ঞা। আর নির্দেশমূলক নীতিগুলি হল সামাজিক, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি ইতিবাচক কর্তব্যের নির্দেশ। অধিকারগুলির চরিত্র নেতিবাচক। রাষ্ট্রকে এগুলি কতকগুলি কাজ করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়। অপরদিকে নীতিগুলি হল রাষ্ট্রের কার্য অনুসরণের জন্য কতকগুলি ইতিবাচক নির্দেশ।

● (২) মৌলিক অধিকারগুলি নাগরিকদের অধিকারকে প্রসারিত করার জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নীতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সীমা সঙ্কুচিত করে। আর নীতিগুলি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও দায় দায়িত্বের পরিধিকে সমাজতান্ত্রিক পথে বিস্তৃত করে। সরকার কোন্ কোন্ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়াসী হবে এবং কোন্ কোন্ কার্যসম্পাদনের জন্য সচেষ্ট হবে নীতিগুলি তারই নির্দেশ দেয়।

● (৩) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মৌলিক নীতি হিসাবে গণ্য হলেও, নীতিগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয় (৩৭ ধারা)। যেমন, ৪১ ধারায় প্রদত্ত কর্মের ও শিক্ষার অধিকার এবং বেকার, বার্ধক্য ও পীড়িত অবস্থায় সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আদালতের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করা যায় না। অপরপক্ষে সংবিধানের ৩৩ এবং ২২৬ ধারা অনুসারে মৌলিক অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য।

● (৪) সংবিধানের ১৩ (২) ধারা অনুসারে মৌলিক অধিকার বিরোধী আইন বাতিল হয়ে যায়। অর্থাৎ মৌলিক অধিকার অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু নির্দেশমূলক নীতির সঙ্গে পার্লামেন্ট প্রণীত কোন আইনের বিরোধ বাধলে আইনই বলবৎ হয়। অর্থাৎ কোন আইন নির্দেশমূলক নীতির বিরোধী, কেবলমাত্র এই যুক্তিতে তা বাতিল হয় না।

● (৫) মৌলিক অধিকারের আইনগত স্বীকৃতি ও ভিত্তি আছে; নির্দেশমূলক নীতির নেই। মৌলিক অধিকারগুলি এককভাবে কার্যকরী হয়; এই উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র কোন আইন প্রণয়ন করতে হয় না। কিন্তু নির্দেশমূলক নীতিকে এককভাবে কার্যকর করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করতে হয়। মৌলিক অধিকারগুলি জনগণ সরাসরি সংবিধান থেকে লাভ করে। আর নীতিগুলিতে অন্তর্ভুক্ত অধিকারসমূহ লাভ করতে হলে সেই উদ্দেশ্যে পৃথক আইন প্রণয়ন করতে হয়।

● (৬) নীতিগুলি মৌলিক অধিকারের অনুগত অংশ হিসাবে সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছে। উভয়ের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে মৌলিক অধিকারগুলি বলবৎ হয় এবং নীতিগুলি বাতিল হয়ে যায়। নীতিগুলিকে কার্যকর করতে হলে দেখতে হবে সেগুলি যেন মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে এবং তার পরিপূরক ভাবে চলে (চম্পাকম ডোরাইরাজন বনাম চেন্নাই (মাদ্রাজ) রাজ্য সরকার, ১৯৫০)।

● (৭) রাষ্ট্র কেবলমাত্র নীতিগুলির ভিত্তিতে কোন আইন পাস করতে পারে না। অর্থাৎ নীতিগুলি রাষ্ট্রকে কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়নি। কিন্তু কোন মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে এইরকম অবস্থার সৃষ্টি হয় না।

● (৮) সরকারের পক্ষে মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করার বাধ্যবাধকতা আইনগত আর নির্দেশমূলক নীতির ক্ষেত্রে দেশের জনসাধারণ ও নির্বাচকমণ্ডলীই নীতিগুলি প্রয়োগ করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে।