ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত স্বাধীনতার অধিকার | Right to Freedom of Indian Constitution

ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত স্বাধীনতার অধিকার | Right to Freedom of Indian Constitution

■ প্রশ্ন:- ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত স্বাধীনতার অধিকারের প্রকৃতি আলোচনা করো। (Right to Freedom of Indian Constitution).

উত্তর:- স্বাধীনতার অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকারের ভিত্তি স্বরূপ। ভারতীয় সংবিধানের ১৯-২২ ধারায় স্বাধীনতার অধিকার উল্লেখ করা হয়েছে। মূল সংবিধানের ১৯ ধারায় সাতটি স্বাধীনতার অধিকার সংযুক্ত ছিল। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের ৪৪ তম। সংশোধনের মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জন, দখল ও হস্তান্তরের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতার অধিকার তথা মৌলিক অধিকারের অধ্যায় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৯ (১) ধারায় বর্তমানে ছ’টি স্বাধীনতার অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। এই ছ’টি স্বাধীনতার অধিকার হল—

● (ক) বাক্য ও মতামত প্রকাশের অধিকার;

● (খ) শান্তিপূর্ণ এবং নিরস্ত্রভাবে সমবেত হবার অধিকার।

● (গ) সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার।

● (ঘ) ভারতের সর্বত্র স্বাধীনভাবে গমনাগমনের অধিকার।

● (ঙ) ভারতের যে-কোন স্থানে বসবাস করার অধিকার। এবং

● (ছ) যে-কোন বৃত্তি গ্রহণ বা উপজীবিকা বা ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার। ভাব-ভাবনার আদান-প্রদানের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক সমাজে অপরিহার্য। কিন্তু বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার এবং সভাসমিতিতে সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা ছাড়া তা সম্ভব হয় না। এই সমস্ত সুযোগ না থাকলে জনমত সংগঠিত হতে পারে না। আর জনমতই হল গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। ভারতীয় সংবিধান মূলমন্ত্রের স্বাধীনতা আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি। আম্বেদকরের মতে মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা কোন আলাদা অধিকার নয়। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যেই মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা নিহিত আছে। রমেশ থাপার মামলায় সুপ্রীম কোর্টও এই অভিমত সমর্থন করেছে। সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই দু’টি অধিকার ছাড়া রাজনৈতিক দল গঠন বা অন্য কোন গণতান্ত্রিক কার্যকলাপ চালু করা যায় না। ভারতের সর্বত্র বিনাবাধায় গমনাগমনের স্বাধীনতার উপর অন্যান্য স্বাধীনতাগুলির ব্যবহারিক প্রয়োগ নির্ভরশীল।

তাছাড়া, ভারতে একনাগরিকত্ব স্বীকৃত। তাই প্রত্যেক নাগরিকের বিনাবাধায় ভারতের সর্বত্র গমনাগমনের ও বসবাসের স্বাধীনতা থাকা দরকার। ভারতের জটিল সমাজব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে বৃত্তি, উপজীবিকা ও ব্যবসা বাণিজ্যের স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছে। উত্তরাধিকারজনিত অপারগতা জাতি, ধর্ম, বর্ণ প্রভৃতি বৃত্তি বা উপজীবিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে যাতে কোন বাধার সৃষ্টি না করে তাই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উপরিউক্ত ১৯ ধারায় ছ’টি স্বাধীনতার অধিকার অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়। অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। ভারতীয় সংবিধানেও তাই দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থের প্রয়োজনে প্রতিটি স্বাধীনতার অধিকারের উপর যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ (Reasonable restriction) আরোপ করা হয়েছে। ১৯ ধারায় ছ’টি উপধারা আছে। প্রথম উপধারাটিতে ছ’টি স্বাধীনতার উল্লেখ আছে। বাকী পাঁচটি উপধারায় ছ’টি স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণগুলির কথা বলা হয়েছে।

প্রথমটিতে ব্যক্তিকে কতকগুলি অধিকার দেওয়া হয়েছে; বাকী পাঁচটিতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও জাতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রণের আকারে রাষ্ট্রের হাতে কতকগুলি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে; তাই এই অধিকারগুলিকে নিয়ন্ত্রিত ও শর্তসাপেক্ষ অধিকার বলা যেতে পারে। বস্তুতপক্ষে ১৯ ধারায় ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সামঞ্জস্য দেখা যায়।

● প্রথমত, রাষ্ট্র বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কয়েকটি কারণে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কারণগুলি হল: (১) ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি; (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা; (৩), বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক; (৪) জনশৃঙ্খলা; (৫) শ্লীলতা ও নৈতিকতা; (৬) আদালত অবমাননা; (৭) মানহানি এবং (৮) অপরাধ অনুষ্ঠানে প্ররোচনা [১৯ (২) ধারা]।

● দ্বিতীয়ত, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতার উপর ‘শান্তিপূর্ণ’ এবং ‘নিরস্ত্র’ এই দু’টি শর্ত প্রাথমিকভাবে আরোপ করা হয়েছে। তা ছাড়া, রাষ্ট্র ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি এবং জনশৃঙ্খলার কারণে এই স্বাধীনতার উপর বাধা-নিষেধ আরোপ করতে পারে [১৯ (৩) ধারা]।

● তৃতীয়ত, ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি, জনশৃঙ্খলা বা সদাচারের স্বার্থে রাষ্ট্র বা সংঘ গঠনের অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে [১৯ (৪) ধারা]। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে, জাতীয় শান্তির বিরোধী সংস্থা গঠন করলে বা বে-আইনী ধর্মঘট করলে রাষ্ট্র তা নিষিদ্ধ করতে পারে।

● চতুর্থত, রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও বসবাসের অধিকার জনস্বার্থ বা তপসিলী উপজাতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে [১৯ (৫) ধারা]।

● পঞ্চমত, রাষ্ট্র জনস্বার্থে বৃত্তি বা উপজীবিকা গ্রহণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে [১৯ (৬) ধারা]। রাষ্ট্র বৃত্তি, উপজীবিকা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বৃত্তি বিষয়ক ও প্রয়োগবিদ্যা-বিষয়ক যোগ্যতা স্থির করে দিতে পারে।

■ সমালোচকদের মতানুসারে-

● (১) রাষ্ট্র উল্লিখিত বিধিনিষেধগুলির মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতা লাভ করেছে।

● (২) বারবার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আদালতের নির্দেশকে অতিক্রম করে এই বিধিনিষেধের তালিকাকে দীর্ঘতর করা হয়েছে। এই প্রবণতা অগণতান্ত্রিক।

● (৩) তাছাড়া ‘জনস্বার্থ’, ‘জনশৃঙ্খলা’, ‘অপরাধ অনুষ্ঠানে প্ররোচনা’ প্রভৃতি ধারাগুলি অস্বচ্ছ এবং ব্যাপকভাবে অর্থবহ। তাই এসবের অজুহাতে অনেকক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপের আশঙ্কা থাকে। স্বাধীনতার অধিকারগুলি অবাধ নয়। তেমনি অধিকারগুলির উপর আরোপিত বাধা নিষেধগুলিও অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত ও স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না।

সংবিধানে বলা হয়েছে যে, বিধি-নিষেধ ‘যুক্তিসঙ্গত’ হবে। আর এই যুক্তিসঙ্গতা বিচার করবে আদালত-আইন বা শাসন-বিভাগ নয়। যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধের সমর্থনে সুপ্রীম কোর্টের বক্তব্য হল যে, আইনের উদ্দেশ্য যদি বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ সিদ্ধ করে, তাহলে সামগ্রিক স্বার্থে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায় (গোপালন বনাম মাদ্রাজ সরকার)। কিন্তু সংবিধানে ‘যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ’ কাকে বলে তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। তবে চিন্তামন রাও বনাম মধ্যপ্রদেশ সরকার মামলায় সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিধি-নিষেধগুলি স্বেচ্ছাচারমূলক এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত হবে না। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য সাধন করতে পারলে বিধি-নিষেধ যুক্তিসঙ্গত হবে। শ্রীদুর্গাদাস বসুর মতানুসারে, যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধকে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়কারী হতে হবে।