ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন ধরনের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা | Different Types of Land Revenue System in British Period
■ বিভিন্ন ধরনের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা:-
■ পাঁচসালা ও একসালা বন্দোবস্ত:- এদেশে ভূমি-রাজস্ব নিয়ে পরিবর্তনের কথা প্রথম ভাবেন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস। প্রথমে তিনি পাঁচসালা বন্দোবস্তের প্রচলন করেন (১৭৭২ খ্রিঃ)। এই ব্যবস্থায় প্রকাশ্য নিলামে যে সর্বোচ্চ ডাক দিত তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হত। এটি ছিল একটি সর্বনাশা ব্যবস্থা।
কারণ জমি সম্পর্কে অনভিজ নীতিজ্ঞানহীন অসাধু ফাটকাবাজেরা যেমন উঁচু ডাক ডেকে পুরানো জমিদারদের জমি থেকে অধিকারচ্যুত করতে পারত, তেমনি এই ব্যবস্থায় জমির উপর ইজারাদারদের কোনো স্থায়ী অধিকার গড়ে না ওঠায় তারা ওই সময়ের মধ্যে প্রজাকে যতখানি পারা যায় শোষণ করত।
জমির উন্নতির দিকেও তারা নজর দিত না। ফলে রায়তরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হত। আবার বহু জমিদার-ইজারাদার নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দিতে অসমর্থ হওয়ায় জমিদারি হারাত। ফলে সরকারেরও ক্ষতি হত অনেক। তাই পাঁচসালা ব্যবস্থার অবসানে (১৭৭৬ খ্রিঃ), হেস্টিংস একসালা ব্যবস্থায় ফিরে এলে বড়লাটের কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য বারওয়েল প্রস্তাব করেন যে, হয় নিলাম মারফত ভূমি বিক্রি, নয় ইজারাদারদের সঙ্গে সারা জীবনের জন্য জমি বন্দোবস্ত করা হোক। কাউন্সিলের আর এক সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস, ভূমি বন্দোবস্ত দিয়ে স্থায়ী ও নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাব করেন।
■ দশসালা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত:- কর্নওয়ালিস গভর্নর-জেনারেল হয়ে এদেশে আসার আগে থেকেই তাহলে এক ধরনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা উঠেছিল। হেস্টিংসও শেষ পর্যন্ত যথাসম্ভব পুরাতন জমিদারদের সঙ্গে যাবজ্জীবন বা দু-জনের জীবিতকাল পর্যন্ত জমির বন্দোবস্তের পক্ষপাতী হয়ে ওঠেন। যাইহোক, কর্নওয়ালিস কিন্তু এদেশে আসার সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্দেশ নিয়েই এসেছিলেন। অবশ্য তাঁকে প্রথমে দশ বছর অস্থায়ী ব্যবস্থার এবং সুবিধা বুঝে তা চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত করার কথা বলা হয়। সেইমতো কর্নওয়ালিস প্রথমে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই ফেব্রুয়ারি জমিদারদের সঙ্গে দশসালা বন্দোবস্ত করেন।
পরে তিনি জন শোর, চার্লস্ গ্রান্ট, ফিলিপ ফ্রান্সিস, থর্নটন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মার্চ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত – এ পরিণত করেন। প্রথমে বাংলা, বিহার, ওড়িশায় এবং পরে বারাণসীতে এই বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। এই ব্যবস্থা অনুসারে জমিদার বংশানুক্রমে জমির মালিক বলে স্বীকৃত হয়। কোম্পানিকে দেয় জমিদারের রাজস্বের পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। স্থির হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাজস্ব মেটাতে না পারলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে; কোনো কারণেই রাজস্ব মকুব হবে না।
■ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কেন:- কর্নওয়ালিস কেন জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে আসতে রাজি হয়েছিলেন তা দেখা যাক। কর্নওয়ালিস নিজেই একবার বলেছিলেন জমিদার বা কৃষকের স্বার্থের কথা ভেবে কিন্তু তিনি এই ব্যবস্থায় আসেননি। এক্ষেত্রে কোম্পানির স্বার্থের কথাই তিনি আগাগোড়া ভেবেছিলেন। ইতিপূর্বে রাজস্ব থেকে কোম্পানির আয়ের কোনো স্থিরতা ছিল না। ওই আয় কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে। তাই এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব থেকে কোম্পানির আয়কে তিনি নির্দিষ্ট করতে চেয়েছিলেন। তিনি একথাও চিন্তা করেছিলেন যে, ভূমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার দান করে তিনি বিদেশি শাসনের প্রতি জমিদারদের আনুগত্য ক্রয় করতে পারবেন। তা ছাড়া, বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে কৃষির উন্নতিও জড়িত। আর মালিকানার অধিকার পেলে তবেই ভূমির উপর পুঁজি বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে।
■ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দুটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।
প্রথমত, এর ফলে জমিদার ও রাজস্ব সংগ্রাহকরা বংশানুক্রমিকভাবে জমির মালিক হিসাবে স্বীকৃত হয়। অন্যদিকে কৃষকরা কেবল খাজনাদানকারী একদল মানুষে পরিণত হয়। জমি-জমা, বন-জঙ্গল, চারণভূমি ইত্যাদির উপর সমস্ত রকম অধিকার তারা হারায়।
দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থায় জমিদারদের সরকারকে দেয় ভূমি-রাজস্ব চিরকালের জন্য বেঁধে দেওয়া হলেও কৃষকরা জমিদারকে কী পরিমাণ খাজনা দেবে, তা কিন্তু বেঁধে দেওয়া হল না।
■ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল:- এই বন্দোবস্তের ফলে একদিকে জমিদাররা ভূমির উন্নতি ও রাজস্ব বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিলে জমির মূল্য যেমন বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি শিল্প-বাণিজ্যের দিকে না গিয়ে বহু লোক জমিতে মূলধন বিনিয়োগ করতে শুরু করলে কুটিরশিল্প সহ অন্যতর শিল্প-বাণিজ্য উপেক্ষিত হয়। তবে ভূমি-রাজস্ব ব্যাপারে আয় নিশ্চিত হওয়ায় সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়ব্যয়ের একটা ‘বাজেট’ তৈরি করা সহজ হয়। সেইসঙ্গে সরকার শাসনকার্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগ দিতে সক্ষম হয়। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব এই বন্দোবস্তের আর একটি ফল। কিন্তু এই বন্দোবস্তে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জমিদারদের অত্যাচারে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। তাদের ওপর ক্রমবর্ধমান রাজস্বের হার বৃদ্ধি ছিল এই ব্যবস্থার নিষ্ঠুর পরিণতি।
আবার সূর্যাস্ত -আইন অনুসারে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে রাজস্ব জমা দিতে না পারায় বহু প্রাচীন জমিদারবংশ শেষ হয়ে যায়। সর্বোপরি, এই ব্যবস্থার ফলে ভূমির মূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও ভূমি-রাজস্ব বৃদ্ধির কোনো সুযোগ না থাকায় সরকারের আর্থিক সংগতি সীমিত হয়ে পড়ে।
■ রায়তওয়ারী ব্যবস্থা:- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল এইভাবে সন্তোষজনক না হওয়ায় কোম্পানির সরকার প্রথমে মাদ্রাজ ও পরে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারী ব্যবস্থা নামে এক নতুন ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থা প্রচলন করেন। আলেকজান্ডার রিড ও টমাস মনরো -র উদ্যোগে ১৮২০ সালে মাদ্রাজের অধিকাংশ অঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু হয়। এর দ্বারা সরকার সরাসরি রায়তদের সঙ্গে ব্যবস্থায় আসেন। প্রথম দিকে উৎপাদনের অর্ধাংশ রাজস্বরূপে দাবি করা হয়েছিল; পরে তা কমিয়ে এক-তৃতীয়াংশে আনা হয়। নগদ অর্থে এই রাজস্ব দিতে হত। এই ব্যবস্থায় রায়ত ভূমির মালিকরূপে স্বীকৃতি পেয়েছিল বলে মনে হয় না। আসলে সে রাষ্ট্রের ভাড়াটিয়া প্রজায় পরিণত হয়েছিল। যতদিন সে রাজস্ব দিয়ে যেত, ততদিন তাকে ভূমি থেকে বিতাড়নের কোনো প্রশ্নই উঠত না। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় মালিকানা স্বত্ব না পেলেও কৃষক জমি ভোগ করার স্বত্ব লাভ করেছিল। তাই বলা হয় যে,
রায়তওয়ারী ব্যবস্থা সরকার এবং রায়তদের মাঝখান থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিতে পেরেছিল। তবে আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে যে, ধীরে-ধীরে এই ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও মধ্যস্বত্বভোগীর দল গড়ে উঠেছিল। রায়তওয়ারী-ব্যবস্থা বোম্বাই -এ চালু হয় ১৮২৭ -এ। তবে এখানে খেতগুলোর রাজস্ব স্বতন্ত্রভাবে নির্ণয় না করে যৌথভাবে নির্ণীত হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, রায়তদের মধ্যে জমি লিজের (Lease) ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তৃতীয়ত, রাজস্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে এখানে উৎপাদন-ভিত্তিক প্রথা বাদ দিয়ে ভূমির মূল্য-ভিত্তিক প্রথাকে গ্রহণ করা হয়েছিল।
যাইহোক, এই ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল খুব চড়া এবং সাধারণত ২০/৩০ বছর অন্তর রাজস্বের হার নবীকরণ করা হত।
■ মহলওয়ারী ব্যবস্থা:- গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্যভারতের কিছু স্থানে জমিদারি ব্যবস্থাকে ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে প্রচলন করা হয় উনিশ শতকের তিনের দশকে। এটি মহলওয়ারী ব্যবস্থা নামে পরিচিত। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ‘মহল’ বা ‘তালুক’ গড়া হত। এই প্রথায়
● (১) ভূমির উপর রায়তের অস্পষ্ট অধিকার সুস্পষ্ট অধিকারে পরিণত হয়।
● (২) মহলের কোনো ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে সরকার ৩০ বছরের মেয়াদে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থায় আসে।
● (৩) নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজস্বের হার সংশোধিত হত। তবে রায়তওয়ারী ব্যবস্থার মতো এই ব্যবস্থাতেও রাজস্বের হার ছিল বেশ চড়া।
■ ভাইয়াচারি ব্যবস্থা:- এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল পাঞ্জাবে। এতে গ্রামের প্রত্যেক চাষির সঙ্গে পৃথক পৃথক ভাবে জমির বন্দোবস্ত ও রাজস্বের হার ধার্য করা হত। গ্রামেরই এক ব্যক্তির ওপর রাজস্ব আদায়ের ভার ন্যস্ত হত। এই ব্যবস্থায় কয়েক বছর অন্তর অন্তর রাজস্বের হার নবীকরণ করা হত।
■ ব্রিটিশের রাজস্বনীতির সামগ্রিক ফলাফল:- কোম্পানি-শাসনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ করলে বলা যায় যে, এর ফলে সর্বত্র কৃষকরাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নতুন ব্যবস্থায় তাদের ভাগ্যের কখনও কোনো উন্নতি ঘটেনি। বরং এর বৈশিষ্ট্য ছিল কৃষকের উপর ক্রমবর্ধমান রাজস্বের ভার বৃদ্ধি। রাজস্ব জমা দিতে না পেরে তারা তাদের জমি হারিয়েছে। এইভাবে ওই সমস্ত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ইংরেজ সরকার এদেশের ভূমিকে যেন একটি বস্তুতে পরিণত করেছিল, যা বন্ধক রাখা, কেনাবেচা বা হস্তান্তর করা যেত। এইভাবেই তারা এদেশের ভূমি-ব্যবস্থায় একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল, যার ফলে ভূমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার রায়ত কোনোদিনই ভোগ করতে পারেনি।
সর্বোপরি, ভূমি রাজস্ব ক্ষেত্রে কোম্পানির ওইসব বিভিন্ন ব্যবস্থার ফলে ভারতীয় সমাজে শ্রেণি-বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। পুষ্ট হয় জমিদারশ্রেণি; সৃষ্টি হয় সামান্য ভূমির অধিকারী কৃষকের দল এবং অসংখ্য ভূমিহীন খেতমজুর।