The First World War: Against the backdrop of imperialism, the causes of The First World War and its aftermath were the European Revolution of the late eighteenth century. The insanity that engages in competition and which results in most of the countries outside Europe becoming colonies of European nations is called imperialism or male imperialism. Conflict between the old imperialists and the new imperialists: in England, France, Russia, Portugal, Spain, etc., they are far ahead in establishing colonial empires in various countries of Asia and Africa due to the pre-industrial revolution.
সাম্রাজ্যবাদের পটভূ মিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও তার ফলাফল(The causes and consequences of The First World War against the backdrop of imperialism):
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে ইউরােপের শিল্পবিপ্লবের ফলে উদ্বৃত্ত মালপত্র বিক্রয়, শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ এবং শিল্প মালিকদের হাতে সঞ্ছিত মূলধন বিনিয়ােগের জন্য ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশগুলির শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা ইউরােপের বাইরে বিশেষত পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার উপনিবেশ দখলের জন্য যে উন্মাদ প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয় এবং যার ফলে ইউরােপের বাইরের অধিকাংশ দেশ ইউরােপীয় জাতিদের উপনিবেশে পরিণত হয়, তাকেই সাম্রাজ্যবাদ বা নর সাম্রাজ্যবাদ বলা হয়।
[ ১ ] পুরােনাে সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বন্দ্ব :
ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , রাশিয়া , পাের্তুগাল , স্পেন প্রভৃতি দেশে আগেভাগেই শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য তারা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের ব্যাপারে বেশ এগিয়ে থাকে। জার্মানি, ইতালি, অষ্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশগুলিতে এর কিছু পরেই শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের আমলে জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব ঘটলে উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য জার্মানি এবং ইতালি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর আগেই ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , রাশিয়া , পাের্তুগাল প্রভৃতি দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে বসে থাকায় উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে এই দুটি দেশ সর্বত্রই প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। জার্মানি ও ইতালির অতৃপ্ত ঔপনিবেশিক আকাঙ্ক্ষা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য করে তােলে ।
( ১ ) অতৃপ্ত জার্মানির ওয়ার পলিটিক্স ও ব্রিটেনের আশঙ্কা : একটু দেরিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করার পর সর্বত্রই প্রতিরােধের সম্মুখীন হলে সাম্রাজ্য বিস্তারের অতৃপ্ত আকাঙ্খ পূরণের জন্য জার্মানি যুদ্ধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে দেখতে থাকে এবং থল ও নৌবাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে চলে । জার্মানির এই ওয়ার পলিটিক্স নীতিতে ব্রিটেনের আশঙ্কা হয় যে , জার্মানি ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি গ্রাস করতে চায় । ব্রিটেনের এই আশঙ্কাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তােলে ।
( ২ ) ইঙ্গ – জার্মান নৌপ্রতিদ্বন্দ্বিতা : জার্মানি নৌ – শক্তি বৃদ্ধি করলে উত্তর সাগর ও ইংলিশ চ্যানেলের ব্রিটিশ উপকূল আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারও তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি করে । এইভাবে ইঙ্গ – জার্মান নৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।
( ৩ ) বুয়র যুদ্ধ ; দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিটিশ উপনিবেশে বুয়রদের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে ব্রিটেনের যুদ্ধ শুরু হয় । এই যুদ্ধের সময় কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বুয়ের প্রেসিডেন্ট গারকে সাহায্য দানের প্রস্তাব পাঠালে ইংল্যান্ড অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় ।
( ৪ ) ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব : ইতালি ফ্রান্সের উত্তর আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে তার নায্য অধিকার আছে বলে মনে করত । এর ফলে উভয় দেশের মধ্যে প্রবল বিরােধের সৃষ্টি হয় ।
( ৫ ) অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে বিরােধ : অস্ট্রিয়া বার্লিনের সন্ধি অস্বীকার করে বসনিয়া ও হারজেগোবিনা দখল করায় সার্বিয়া ক্ষুব্ধ হয় , কারণ এই দুটি অঞ্চলেই সার্ব জাতির লােক বসবাস করত । এই কারণে অস্ট্রিয়া – সার্বিয়া বিরােধ চরম আকার ধারণ করে । উপনিবেশ বিস্তারকে কেন্দ্র করে এইভাবে ইউরােপীয় রাজনীতি জটিল আকার লাভ করে এবং প্রত্যেকটি শিল্পোন্নত দেশ নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়।
[ ২ ] সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ :
ইউরােপীয় দেশগুলাের সাম্রাজ্যবাদী মনােভাবের সঙ্গে এই সময় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী সংঘাত যুক্ত হয় । ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ইউরােপের বিভিন্ন দেশে এক ধরনের সংকীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে । এই জাতীয়তাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইউরােপের প্রায় সব জাতির মধ্যেই নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার এবং অন্যান্য জাতি ও দেশকে ঘৃণা ও পদানত করার সংকীর্ণ প্রবণতা দেখা দেয় । এই উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদই ইউরােপের বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে বিদ্বেষ ও জাতিবৈরিতার সৃষ্টি করে । এই অবস্থায় সুস্থভাবে কূটনৈতিক মত বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা ইউরােপের বিভিন্ন দেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে । এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তােলে , যেমন :
( ১ ) উগ্র জাতীয়তাবাদ ও জার্মানির উচ্চাকাঙক্ষা : জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে উদ্ভূত উচ্চাকাঙক্ষা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ । উনবিংশ শতকের শেষের দিকে বিসমার্কের চেষ্টায় জার্মানি একটি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয় । তারপর আরম্ভ হয় জার্মানির ইতিহাসে এক নতুন গৌরবময় অধ্যায় । ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সকে পরাস্ত করে জার্মানি ইউরােপের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয় । জার্মানি জগতের শ্রেষ্ঠ জাতি , সুতরাং জার্মানির কর্তব্য হল বিশ্বের সব জাতির উপর প্রভুত্ব স্থাপন করা ‘ — এই ভাবনা জার্মান জাতির মনে বিস্তারের উন্মাদনা মধ্যে সৃষ্টি করে । সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম কাইজার নতুন বিশ্বনীতি ” র কথা ঘােষণা করে জার্মান জাতির মধ্যে বিস্তারধর্মী আকাঙ্খা বাড়িয়ে তােলেন । কাইজারের সাম্রাজ্যবাদী মনােভাব ইউরােপে এক দারুণ আশঙ্কার সৃষ্টি করে । অবশ্য এই ধরনের সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবােধ শুধুমাত্র জার্মানিতেই দেখা যায় নি । এই সময় ফ্রান্স , ইতালি , ইংল্যান্ড , রাশিয়া এবং জাপানেও এই ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনােভাবের কম – বেশি প্রকাশ দেখা গিয়েছিল ।
( ২ ) ফ্রান্স – জার্মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা : জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পশ্চিম ইউরােপের শান্তির পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । ১৮৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির কাছে পরাজয়ের গ্লানি ফ্রান্স ভুলতে পারেনি । এই যুদ্ধে জার্মানির কাছে ফ্রান্স আলসাস ও লােৱেন প্রদেশ হারায় । কিন্তুস্বেচ্ছায় ফ্রান্সকে তা ফিরিয়ে দিতে জার্মানি মােটেই রাজি ছিল না । সুতরাং জার্মানির সঙ্গে । ফ্রান্সের যুদ্ধ ছিল অনিবার্য ।
( ৩ ) বলকান জাতীয়তাবাদ : বলকান অঞ্চলের জনগণের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদও ইউরােপের শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে । তুর্কী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বলকান অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের প্রশ্নে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়া , সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া এবং অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ব – ইউরােপকে অশান্ত করে তােলে , তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইন্ধন যােগায় ।
[ ৩ ] দুটি সামরিক শিবিরে বিভক্ত ইউরােপ :
ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , রাশিয়া , অস্ট্রিয়া , জার্মানি , ইতালি প্রভৃতি দেশগুলাের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক , সামরিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ পর্যন্ত ইউরােপকে দুটি পরম্পর – বিরােধী সামরিক শিবিরে বিভক্ত করে — একদিকে জার্মানি , অস্ট্রিয়া ও ইতালির মধ্যে ব্রি – শক্তি মৈত্রীজোট এবং অপর দিকে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি আঁতাত জোট । দুই পক্ষই যুদ্ধের আশঙ্কায় নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ(The direct cause of The First World War):
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ২৮ শে জুন অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী । যুবরাজ আর্চ ডিউক ফার্ডিনান্ড ও তাঁর পত্নী বােসনিয়া প্রদেশের রাজধানী সেরাজেভাে নগরে বেড়াতে যান । সেখানে এক আততায়ীর হাতে পত্নীসহ তিনি নিহত হন , এই আততায়ী ছিল অস্ট্রিয়ার প্রজা এবং জাতিতে শ্লাভ । অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যভুক্ত গ্লাভদের প্রশ্ন নিয়ে সার্বিয়ার সঙ্গে অস্ট্রিয়ার বিরােধ আগে থেকেই ছিল । হত্যাকাণ্ডের অজুহাতে অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে ও তার কাছে কয়েকটি অসম্ভব দাবি উত্থাপন করে । এই দাবিগুলি পুরণের জন্য মাত্র ৪৮ ঘন্টা সময় দেওয়া হয় । সার্বিয়া তাতে রাজি না হওয়ায় অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে । জার্মানি অস্ট্রিয়ার পক্ষে যােগ দেয় । অন্যদিকে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও রাশিয়া জার্মানির রাজ্যলিঙ্গায় বাধা দেওয়ার জন্য সার্বিয়ার পক্ষে যােগ দেয় , ফলে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (The first world war) শুরু হয় ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপকতা(The magnitude of The First World War)
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধ শুধু ইউরােপেই সীমাবদ্ধ ছিল না । তুরস্ক , জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার পক্ষে এবং ইতালি , জাপান , রাশিয়া ও পরে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র , ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষে ( যা মিত্রপক্ষ ’ নামে পরিচিত ছিল ) যােগ দেয় । ফলে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয় । বিশ্বের ইতিহাসে এই ধরনের যুদ্ধ আগে কখনও হয়নি । কয়েকটি নিরপেক্ষ দেশ ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । এই যুদ্ধে বােমারু বিমান , সাবমেরিন বা ডুবােজাহাজ , ভারী কামান ,ট্যাঙ্ক , বিস্ফোরক বােমা , বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে গ্রামের পর গ্রাম ও শহরের পর শহর ধ্বংস হয়ে যায় ।যুদ্ধের সমাপ্তি — ভার্সাই সন্ধি : দীর্ঘ চার বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই নভেম্বর পরাজিত জার্মানি যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের ভাসাই নগরে জার্মানির সঙ্গে মিত্রপক্ষের ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় ও অন্যান্য পরাস্ত দেশের সঙ্গেও সন্ধি হয় ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল ( ১ ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে চারটি বড়াে সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে , যেমন : অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরী , তুরস্ক , রাশিয়া ও জার্মানি । রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের ফলে ইউরােপে চেকোশ্লোভাকিয়া , যুগােশ্লাভিয়া , পােলান্ড প্রভৃতি অনেক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । ফলে ইউরােপের মানচিত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে । ( ২ ) এই যুদ্ধের অন্যতম ফল ছিল জাতীয়তাবাদের সাফল্য । বল্কান অঞ্চলে নির্যাতিত জাতীয়তাবাদের আংশিক সাফল্য হয় । চেকোশ্লোভাকিয়া , রুমানিয়া , যুগােশ্লাভিয়া প্রভৃতি দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রবর্তন করা হয় এবং পুরুষের সঙ্গে নারীদেরও ভােটের অধিকার স্বীকার করা হয়। ( ৩ ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শ্রমিকদের অবদান ছিল সবার চেয়ে বেশি। সুতরাং বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিকশ্রেণি স্বভাবতই নিজেদের গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে । শ্রমজীবীদের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় ইউরােপের অনেক রাষ্ট্রে শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রবর্তন করা হয় । ( ৪ ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিকতার প্রসার ঘটে । আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার উপায় হিসাবে ‘ লীগ – অফ – নেসন নামে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত ছিল ব্রিটেনের শক্তির প্রধান উৎস। যুদ্ধের পর বাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা আদায় করা সহজ হবে – এই আশায় ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা ব্রিটেনকে। [ ২ ] বিশ্বযুদ্ধােত্তর ইউরােপ ও ভারত সব রকমভাবে সাহায্য করেছিলেন। [ ১ ] ভারতবাসীর হতাশা ও অসন্তোষ : ভারতবাসী যে আশা – আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুদ্ধে ব্রিটেন তথা মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল, যুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকারের মনােভাব ভারতবাসীকে হতাশ করে। এখানে মনে রাখা দরকার যে যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য ব্রিটেন তথা মিত্রপক্ষ বিশ্বের পরাধীন জাতিগুলােকে গণতন্ত্র ও জাতীয় আত্ম – নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সহযােগিতা লাভ করেছিল। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হয়ে তারা সেই প্রতিশ্রুতি পালনে মােটেই উৎসাহী হন নি। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য পরাধীন জাতিগুলাের মতাে ভারতবাসীদের মনেও হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দেয়।
[ 2 ] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থনৈতিক সংকট(Economic crisis during, The First World War)
অন্য দিকে যুদ্ধের ফলে ভারতে এক গভীর অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রয়ােজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম খুব বেড়ে যায়। যুদ্ধের পর দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। যুদ্ধের সময় ভারতীয় শিল্পগুলি খুবই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, কারণ বিদেশি জিনিসপত্রের আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর বিদেশি জিনিসপত্রের আমদানি আবার শুরু হয় ও ভারতীয় শিল্পজাত জিনিসপত্রের ওপর চড়া হারে শুল্ক ধার্য হয়, ফলে ভারতের শিল্প সংস্থাগুলির বেশিরভাগই লােকসান সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক সংকটের ফলাফল (The aftermath of the economic crisis after The First World War)
প্রথমত, ভারতের লক্ষ লক্ষ শিল্প শ্রমিক ও মজুর বেকার হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, কৃষি জমির ওপর খাজনার হার বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের দারিদ্র্য চরমে ওঠে এবং তৃতীয়ত, যুদ্ধ শেষ হলে ভারতীয় সেনা ও সামরিক কর্মচারীদের বেশির ভাগই ছাঁটাই হয়ে বেকারে পরিণত হয়। সুতরাং বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের আর্থিক দুরবস্থা চরমে ওঠে। এই অবস্থায় ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতারা স্পষ্টই বুঝতে পারেন যে, জনগণের সুগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনও সুবিচার পাওয়া সম্ভব নয়। [ ৩ ] প্রথম বিশ্বযুদ্মের সময় ভারতীয় রাজনীতিতে তিনটি প্রধান ধারা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় রাজনীতিতে তিনটি প্রধান ধারা লক্ষ করা যায়, যেমন : প্রথমত, এই সময় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্কলহের অবসান হয় এবং চরমপন্থী রাজনীতিবিা কংগ্রেসে যােগদান করেন। দ্বিতীয়ত, হিন্দু মুসলিম ঐক্যস্থাপনের প্রয়াসও লক্ষ্ণৌ চুক্তি এবং তৃতীয়ত, হােমরুল আন্দোলন।
( ১ ) জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্কলহের অবসান :
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের সুরাট অধিবেশনে কংগ্রেসের মধ্যে ভাঙন ঘটে। তার ফলে চরমপন্থীগােষ্ঠী কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং কংগ্রেসে নরমপন্থীদের আধিপত্য বজায় থাকে। এরপর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে চরমপন্থীদের আর কোনাে ভূমিকাই ছিল না। শেষ পর্যন্ত অ্যানি বেসান্তের প্রচেষ্টায় তিলক ও অন্যান্য চরমপন্থীরা কংগ্রেসে যােগদান করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে তিলক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিলকের প্রচেষ্টায় লক্ষৌ কংগ্রেসে ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করা হয়। লক্ষৌ অধিবেশনের পর কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ সংগঠনে রূপান্তরিত হওয়ায় জাতীয় আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমেই বেড়ে যায়।
( ২ ) হিন্দু মুসলিম ঐক্য স্থাপনের প্রয়াস ও লক্ষ্মৌ চুক্তি ( ১৯১৬ খ্রিঃ ) :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেস জাতীয় আন্দোলনকে জোরদার করে তােলার জন্য মুসলিম লীগের সঙ্গে আপােষ মীমাংসায় আসতে প্রয়াসী হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপনের ব্যাপারে লােকমান্য তিলকের এক বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তিনি জাতীয়তা -বাদী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। এই ঐক্যের জন্য তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রথা ( ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মলে – মিন্টো সংস্কার আইন দ্বারা স্বীকৃত ) ও মুসলমানদের বিশেষ সুযােগ সুবিধা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ অধিবেশনে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে স্থির হয়, যে :
( ১ ) প্রতিটি প্রাদেশিক আইনসভাতে মােট সদস্যের এক – তৃতীয়াংশ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত হবে ;
( ২ ) কেন্দ্রীয় আইনপরিষদের মােট সদস্যের এক তৃতীয়াংশ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত হবে ;
( ৩ ) এর বিনিময়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যুগ্মভাবে ভারতীয় কাউন্সিলের বিলুপ্তি ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি সরকারের কাছে পেশ করতে রাজি হয় এবং
( ৪ ) মুসলিম লীগ কংগ্রেসের ‘ স্বরাজ ’ আদর্শ মেনে নেয়।
লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্ব :
হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের ক্ষেত্রে লক্ষৌ চুক্তিকে এক উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ বলা যায়। এই চুক্তি প্রমাণ করে যে, ধর্মের দিক থেকে স্বতন্ত্র হলেও ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের একসঙ্গে যুক্ত হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ আছে। অবশ্য গান্ধিজি এই চুক্তি সম্বন্ধে খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন না। তিনি এই চুক্তিকে শিক্ষিত ও ধনী হিন্দু এবং শিক্ষিত ও ধনী মুসলমান নেতাদের মধ্যে একটি বােঝাপড়া মাত্র বলে অভিহিত করেন। তবুও একথা অস্বীকার করা যায় না যে, ভারতের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক সংস্থার যুগ্ম দাবি সরকারের পক্ষে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। এই সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল।
( ৩ ) হােমরুল আন্দোলন : ‘হােমরুল’ কথার অর্থ হল ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অনুরুপ স্বায়ত্ত শাসন’অর্থাৎ কেন্দ্রের হাতে বৈদেশিক নীতি – নির্ধারণ, সামরিক বাহিনী, শুল্ক বিভাগ, ডাক তার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি থাকলেও অভ্যন্তরীণ অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আধিপত্য অর্জনের দাবির ভিত্তিতেই ভারতে হােমরুল আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এছাড়া এই আন্দোলনে কেন্দ্রীয় আইনপরিষদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আরও বেশি সংখ্যায় নিয়ােগের দাবিও তােলা হয়। আয়ারল্যান্ত্রে হােমরুল লীগের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অ্যানি বেসান্ত ও লােকমান্য তিলক ভারতে হােমরুল লীগ গঠনে সচেষ্ট হন।
[ ক ] অ্যানি বেসান্ত কর্তৃক লীগ প্রতিষ্ঠা :
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে আনি বেসান্ত ‘হােমরুল লীগ’ নামে এক পৃথক রাজনৈতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। লীগের উদ্দেশ্য ছিল— “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হােমরুল বা স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা এবং সেই উদ্দেশ্যে জনতাকে শিক্ষিত ও সংগঠিত করে তােলা।”
আন্দোলনের বিস্তার : কিছুদিনের মধ্যেই মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতা, কানপুর, এলাহাবাদ, বেনারস প্রভৃতি স্থানে হােমরুল লীগ এর শাখা স্থাপিত হয়। অ্যানি বেসান্ত ‘ নিউ ইণ্ডিয়া ’ ও ‘ দ্য কমন উইল’নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করে হােমরুল আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করেন। অ্যানি বেসান্ত – এর লীগের কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক বিস্তৃত। গ্রাম ও শহরে তার ২০০ টি শাখা কার্যালয় ছিল। তিনি মাদ্রাজ থেকে লীগের কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অ্যানি বেসান্ত প্রতিষ্ঠিত হােমরুল লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল ২৭ হাজারেরও বেশি।
[ খ ] লােকমান্য তিলক কর্তৃক হোমরুল লীগ প্রতিষ্ঠা : অ্যানি বেসান্তের অনুকরণে বালগঙ্গাধর তিলক মহারাষ্ট্রে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারতীয় হােমরুল লীগ প্রতিষ্টা করেন। তিনি লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যগুলি ব্যাখ্যা করেন :
( ১ ) স্বরাজের উদ্দেশ্যে স্বশাসিত সরকার গঠন। ( ২ ) ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন। ( ৩ ) মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান এবং ( ৪ ) অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ। আন্দোলনের বিস্তার : তিলক তার মারাঠা ’ ও ‘ কেশরী ‘ পত্রিকা দুটিতে হােমরুল আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করতে লাগলেন। ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত তিলক পরিক্রমা করেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। শীঘ্রই তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। লােকমান্য ’ অভিধায় তিনি বন্দিত হলেন। ক্রমশ তিলকের এই আন্দোলন মহারাষ্ট্র , কর্ণাটক , মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। ১৯১৮ খৃস্টাব্দের তিলক প্রতিষ্ঠিত হােমরুল লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩২ হাজারেরও বেশি।
এইভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অ্যানি বেসান্ত ও তিলকের প্রচেষ্টা সফল হয়। একই আদর্শ নিয়ে দুটি হােমরুল লীগ গঠন করা হলেও অ্যানি বেসান্ত ও তিলকের কর্মক্ষেত্র আলাদা হওয়ায় তাদের মধ্যে বিরােধের সম্ভাবনা ছিল না। বস্তুত হােমরুল আন্দোলনের প্রভাবে জাতীয় আন্দোলনের শিকড় গ্রামেগঞ্জে জনমানসের গভীরে প্রবেশ করে। এই প্রসঙ্গে এইচ এফ আওয়েন বলেছেন অবহেলিত প্রদেশে জাতি , ভাষা ও বিভিন্ন বৃত্তির মানুষকে হােমরুল লীগ সামিল করেছিল। [ গ ] হােমরুল আন্দোলনের মূল্যায়ন : সরকারি দমন নীতির ফলে হােমরুল লিগ আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও, এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কিন্তু পুরােপুরি ব্যর্থ হয় নি, কারণ :
( ১ ) ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি দমন নীতির পরিণাম ভয়ংকর হবে আর সেই কারণেই তদানীন্তন ভারত সচিব মন্টেগু নীতিগত ভাবে স্বায়ত্বশাসনের দাবি মেনে নেন। ( ২ ) জাতীয় আন্দোলনের মুহূর্তে হােমরুল আন্দোলন জাতীয় রাজনীতিকে সংগ্রামী ও গণমুখী করে তুলতে সক্ষম হয়।( ৩ ) পরিশেষে বলা যায় , হােমরুল আন্দোলন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে গান্ধি – যুগের পূর্বাভাষ সূচনা করেছিল। কারণ , হােমরুল আন্দোলনের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে গান্ধিজি সর্বভারতীয় গণ – আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
আরও পডুনঃ গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস