স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী | Swami Vivekananda Biography PDF
[অনুরূপ রচনাঃ একজন বাঙালী মহাপুরুষ; তোমার জীবনের আদর্শ পুরুষ; মানবপ্রেমিক স্বামী বিবেকানন্দ; তোমার প্রিয় মহাপুরুষ।]
[রচনা-সংকেতঃ ভূমিকা (আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ কেন) জন্ম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষা- পাশ্চাত্ত্য দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন, ব্রাহ্মধর্মের প্রতি সাময়িক অনুরাগ ঠাকুর রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ ধর্মসংঘের প্রতিষ্ঠা ও ভারত পরিভ্রমণ -আমেরিকা গমন ইংলণ্ড গমন রামকৃষ্ণ মিশন ও বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা -মহাপ্রয়াণ, রচনাবলী ও ভাষণ উপসংহার।]
◾ভূমিকা (আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ কেন):-
বৈষ্ণব-সাধক চণ্ডীদাস গেয়েছেন- ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত প্রেমধর্মও মানবপ্রেম। একই মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার আর এক সন্ন্যাসী উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন-‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ এই মানবপ্রেমিক বীর সন্ন্যাসী হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
এমন মানবপ্রেমের মূর্তবিগ্রহ যিনি, নিপীড়িত মানবাত্মার সেবা যাঁর মূলমন্ত্র, তিনি প্রশ্নাতীত ভাবে আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ। ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারী কলকাতার সিমুলিয়ার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে আবির্ভূত হন স্বামী বিবেকানন্দ। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ। তাঁর বাল্যনাম বিলে। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত, মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। নরেনের সংস্কারমুক্ত উদার মন, অবারিত প্রাণপ্রাচুর্য, জন্ম, পিতৃপরিচয় ও শিক্ষা খেলা-ধূলা-গান-বাজনার প্রতি অনুরাগ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
তাছাড়া খুব ছেলেবেলা থেকে তাঁর মনে ধর্মভাবের উন্মেষ হয়। প্রতি সন্ধ্যায় নিয়মিত বসতেন ঈশ্বর-ধ্যানে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেট্রোপলিটন ইস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। তারপর প্রেসিডেন্সী কলেজ, সেখান থেকে জেনারেল এসেমব্লি কলেজে (স্কটিশ চার্চ) অধ্যয়ন করেন এবং বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
দর্শনশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নরেন পাশ্চাত্ত্য দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন গভীর মনোযোগ পাশ্চাত্ত্য দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন ও ব্রাহ্মধর্মের প্রতি সাময়িক অনুরাগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে। ফলে তাঁর মন ক্রমে সংশয়বাদী হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মবন্ধু কেশবচন্দ্র সেনের সান্নিধ্যে আসেন নরেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মে। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও বিশ্ব চরাচরের নিগূঢ় সত্য বিষয়ক নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা তাঁর মনকে বিচলিত করতে থাকে।
নরেন একদিন এলেন ঠাকুর তাঁর কাছে পেলেন এতদিনের প্রার্থিত সত্যের সন্ধান। ঠাকুরের ইচ্ছায় ও নিজের অন্তরের ঐকান্তিক প্রেরণায় ঠাকুর পরমহংসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন রামকৃষ্ণের কাছে।
◾ঠাকুর রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ:-
১৮৮৬ সালে দেহ রাখলেন ঠাকুর। ঠাকুরের পবিত্র বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে গুরুভাইদের নিয়ে নরেন এক সন্ন্যাসী সংঘ গড়লেন বরানগরে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মসংঘের
◾ধর্মসংঘের প্রতিষ্ঠা ও ভারত পরিভ্রমণ:-
কাজ হল জনসেবা। আত্মনির্লিপ্ত নরেন বন্ধন-অসহিষ্ণু সন্ন্যাসী। নরেন বেরুলেন পদব্রজে ভারত-পরিভ্রমণে। সমগ্র ভারতের অন্তর-মূর্তি ধরা দিল তাঁর চোখে। ভারতবাসীর সীমাহীন দুঃখ-দৈন্য দেখে তিনি ব্যথিত হলেন। উপলব্ধি করলেন সর্বাগ্রে দারিদ্র্যের অভিশাপ মোচন হওয়া দরকার।
◾আমেরিকা গমন:-
আমেরিকার চিকাগো শহরে বসলো ধর্মমহাসম্মেলন। বিবেকানন্দ নাম নিয়ে ১৮৯৩ সালে আমেরিকা যাত্রা করলেন নরেন। ধর্মমহাসম্মেলনে ভারতের হিন্দুধর্ম ও বেদান্তের অদ্বৈতবাদ প্রচার করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে উদ্দেশ্য সফল করলেন তিনি। ইউরোপের নানা জায়গা থেকে তাঁর কাছে ডাক এলো। আমেরিকা থেকে এলেন ইংলণ্ডের মাটিতে। এখানেও প্রচার করলেন বেদান্তের ইংলণ্ড গমন অদ্বৈতবাদ আর সনাতন হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য। আইরিশ মহিলা বিদুষী মিস্ মার্গারেট নোবেল তাঁর সান্নিধ্যে এলেন। পরে ভারতে এসে স্বামীজীর কাছে দীক্ষা নিয়ে হন ‘নিবেদিতা’, যাঁর জনসেবামূলক কাজ দেখে বিমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘লোকমাতা’। অত্যধিক পরিশ্রমে ইউরোপেই স্বামীজীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল।
◾রামকৃষ্ণ মিশন ও বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা:-
স্বামীজী কলকাতায় ফিরেন ১৮৯৭ সালে। তাঁর বিশ্ববিজয়ের গৌরবে ধন্য কলকাতাবাসী তাঁকে নাগরিক সম্বর্ধনা জানায় মানপত্র দিয়ে। প্রত্যুত্তরে স্বামীজী যুবসম্প্রদায়কে ‘অভীঃ’ মন্ত্রে করেন উদ্বুদ্ধ।
হাওড়ায় বেলুড়গ্রামে “বেলুড়মঠ” প্রতিষ্ঠা করেন যা স্বামীজীর স্মরণীয় কীর্তি। রামকৃষ্ণের ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন’।
◾মহাপ্রয়াণ, রচনাবলী ও ভাষণ:-
১৯০২ সালে ৪ঠা জুলাই তাঁর মহাপ্রয়াণ হল। স্বামীজী বিদায় নিলেন, কিন্তু বিশ্ববাসীর জন্য থাকল তাঁর প্রদর্শিত পথ ও বাণী, রচিত গ্রন্থাবলী, অজস্র বক্তৃতা ও ভাষণ। রচিত গ্রন্থ ও বক্তৃতাবলী হল ‘রাজযোগ’, ‘ভক্তিযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্য’ প্রভৃতি। গ্রন্থরাজিতে তাঁর কাব্য ও সাহিত্য-প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর মুদ্রিত আছে।
বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী হলেও মায়াবাদী সন্ন্যাসীদের মতো সমাজ-সংসারকে মনে করতেন না মায়া প্রপঞ্চ। বিশ্বাস করতেন না সর্বইন্দ্রিয়দ্বাররুদ্ধ কঠোর বৈরাগ্যের পথ ঈশ্বর সাধনার উপসংহার পথ। সমাজ-সংসারের সেবার মধ্য দিয়ে মহানন্দময় ‘মুক্তির স্বাদ’-এর প্রত্যাশী ছিলেন তিনি। দেশপ্রীতি ও মানবপ্রেম তাঁকে বীরের শক্তি দিয়েছিল। আর্ত নিঃস্ব নিরন্নের সেবায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।