প্রবন্ধ রচনা- বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা | Science in Bengali language Essay Writing in Bengali

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা | Science in Bengali language Essay Writing in Bengali

[প্রবন্ধ – সংকেত:: ভূমিকা | মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা | বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ও তার ধারা বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ | বিজ্ঞানচর্চার বাংলা পত্র-পত্রিকা | বিজ্ঞানে স্মরণীয় লেখক | উপসংহার]

■ ভূমিকা:- প্রকৃতির অপরূপ রহস্যের প্রতি অনুভূতি ও বিস্ময় সঞ্চারের সোপান বেয়ে যেদিন থেকে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল, সেইদিন থেকেই ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা মহেঞ্জোদড়োর বিজ্ঞানচর্চা সূদুর ব্যবিলন, গ্রীস-রোমের যুগ অতিক্রম করে কালস্রোতের ধারায় সারাবিশ্বে অধিষ্ঠিত হবার পর প্রত্যেক দেশেই মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ঘটে এবং এ বিষয়ে বাংলা ভাষাতেও বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ বাঙালী বিজ্ঞানীদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়েছে।

কারণ তখন বাঙালী বিজ্ঞানীরা বুঝেছিলেন যে, শিক্ষা যেমন মানুষের মনে আলোকরশ্মিরূপে হৃদয়কে আলোকিত করে, তেমনি বিজ্ঞান নিয়ে আসে অনুসন্ধিসু হৃদয়ের পরিপূর্ণতা- আর সেই পরিপূর্ণতার আধার হল- মাতৃভাষা বা বাংলাভাষা। এই কারণে শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যেমন বলে গেছেন— “শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ”, তেমনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ J. R. Firth -ও মন্তব্য করেছেন— “As a first principle, fix your faith to the mother tongue.”

■ মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা:- মাতৃভাষাকে শিক্ষার শ্রেষ্ঠ মাধ্যমরুপে স্বীকৃতি দিয়ে UNESCO এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন যে, “The best medium for teaching is the mother tongue of the pupil.” — এই মন্তব্যের অবতারণা করে বলা যায় যে, মাতৃভাষাতে অর্থাৎ আমাদের বাংলাভাষাতে বিজ্ঞানচর্চার দ্বারা অতি সহজেই প্রথাগত শিক্ষার বাইরে অবস্থানকারী মানুষজনের কাছে বিজ্ঞান চেতনা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব এইজন্য যে, পঠিত বিজ্ঞানের বাংলাভাষায় চর্চা করতে শুরু করলে, বিষয়গুলি যতটাই সাবলীল ও স্বাভাবিকভাবে ফলশ্রুত হবে, তা অন্যভাষার মাধ্যমে অনুশীলন করলে অস্বাভাবিক হয়ে পড়বার আশঙ্কা অনেক বেশী।

তার উপর গবেষণাও বাংলাভাষায় করলে বাঙালী চিত্তে একদিকে যেমন সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে, তেমনি বাংলাভাষার সঙ্গে বাঙালীর নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয় বলেই অনেক বাঙালি বৈজ্ঞানিক- আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিশ্বের দরবারে আপন মহিমাকে গৌরবান্বিত করতে পেরেছেন। চীন, জাপান, জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলি আজ তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা করে বিশ্বখ্যাত হয়েছে।

■ বাংলাভাষায় বিজ্ঞান সূত্রপাত ও তার ধারা:- প্রাচীন ভারতে প্রচলিত সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার ইতিহাসে যেমন নাগার্জুন রচিত ‘লৌহশাস্ত্র’, ‘চরক সংহিতা’ র নাম পাওয়া যায়, তেমনি প্রাচীন বাংলাতেও চাঁদসদাগরের যুগে বিদেশে বাণিজ্যের সূত্রকে অবলম্বন করে, তৎকালীন সময়ের ভেষজ বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্যে বাঙালীর বিজ্ঞানচর্চার কথা জানা যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কী আক্রমণের ফলে বাঙালীর বিজ্ঞানচর্চায় সাময়িক ছেদ পড়লেও, ভারতবর্ষে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই আবার এদেশে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত মেকলের হাত ধরে সারা ভারতে তথা বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করে বাংলাভাষায় চর্চা হতে শুরু করে।

এ বিষয়ে পথিকৃত রূপে সর্বপ্রথম বঙ্কিমচন্দ্র ও অক্ষয় কুমার দত্ত বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে— রসায়ন, শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত প্রবন্ধ রচনা করে বাঙালীকে বিজ্ঞান চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তারপর বাঙালী বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’ র ‘বেতার তরঙ্গ’ নিয়ে বাংলায় গবেষণালব্ধ তত্ত্বটি লন্ডনের Royal Society’ র গোচরে আসার পর তাঁকে Fellow নির্বাচন করা হয়। এবং এরপর তিনি ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করে বাংলাভাষাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পীঠস্থান -এ পরিণত করেন। জগদীশচন্দ্র বসুর পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য ছাত্র জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞানচর্চা করেন।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নিরলস বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস সাক্ষী ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ আজও তার ধারা বজায় রেখেছে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পদার্থবিদ্যায় প্লাঙ্ককোয়ান্টাম তত্ত্ব, মেঘনাদ সাহার পরমাণু জ্যোতিষ গবেষণা, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বিষণ্ন ধাতুর মিলন ঘটিয়ে মারকিউরাস নাইট্রেট আবিষ্কার প্রভৃতি তত্ত্বগুলো ইংরাজীতে প্রকাশিত হলেও, তার প্রকৃত মাধ্যম ছিল বাংলাভাষা।

■ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ : ‘বোস আইনষ্টাইন ’তত্ত্ব’ র প্রবর্তক বিশ্বখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ বসু আচার্য জগদীশ চন্দ্র’র প্রতিষ্ঠিত ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ -এর অনুপ্রেণার ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর মুখপত্ররূপে ‘জ্ঞান বিজ্ঞান’ নামক মাসিক মুখপত্র নিয়মিত প্রকাশ করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা বাঙালীদের উদ্বুদ্ধ করতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

■ বিজ্ঞানচর্চার বাংলা পত্রপত্রিকা:- বিজ্ঞানচর্চার বাংলা পত্রপত্রিকার অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, অনেক যশস্বী লেখক ও বিজ্ঞানসাধক বাংলাভাষাতে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসাবে বাঙালী জনমানসে উৎসাহিত করতে পত্র – পত্রিকাকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই সব লেখক ও পত্রিকাগুলোর পরিচয় ক্রমানুসারে হল- অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘বিদ্যাদর্শন’, পত্রিকাতে তাঁর স্বরচিত রসায়ন, শারীরতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘বিজ্ঞান পুস্তিকা’ নিয়মিত প্রকাশ করতেন এবং সেই পুস্তিকার লেখকগণ ছিলেন— চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, জগদানন্দ রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখরা।

রবীন্দ্রনাথের এই পুস্তিকার প্রভাবে প্রথম উপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে সুকুমার রায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় কিশোর মনের উপযোগী বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা প্রকাশ করতেন। এর আরো অনেক পরে ‘দেশ’ পত্রিকায় বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী রচনা সমরজিৎ কর, সমরেন্দ্র সেন প্রমুখদের রচনা প্রকাশিত হত এবং বর্তমানে প্রচলিত অধিকাংশ মাসিক পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত বিজ্ঞানের শাখা হিসাবে একটি পরিচ্ছদে নিয়মিত বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের চর্চার উপযোগী রচনা বের হতে দেখা যাচ্ছে। এই পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য- ‘কিশোর জ্ঞানভারতী’।

■ বিজ্ঞানে স্মরণীয় লেখক:- মাতৃভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় স্মরণীয় লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেখক ও তাঁদের রচনাবলীর পরিচয় ক্রমানুসারে বিবৃত করা হল এইভাবে- সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বিজ্ঞান রহস্য’, অক্ষয় কুমার দত্তের ‘পদার্থ বিদ্যা’, ‘চারু পাঠ’ বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতি সম্বন্ধ বিচার (১ম ও ২য় খণ্ড), আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রচিত ‘অব্যক্ত’, ‘বিজ্ঞান সাহিত্য’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিশ্বপরিচয়’, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর রচনাসমূহ ‘প্রকৃতি’, ‘জগৎকথা’, ‘জিজ্ঞাসা’, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের রচনা সম্ভার— ‘নব্যবিজ্ঞান’, ‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কাহিনী’, ‘বিশ্বের উপাদান’, ‘তড়িতের অভ্যুত্থান’, ‘ব্যাধির পরাজয়’, ‘পদার্থবিদ্যার নবযুগ’, ‘পরমাণু নিউক্লিয়াস’। এইসব গ্রন্থগুলি লেখকদের দার্শনিক মননশীলতায় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এমন সাবলীলভাবে প্রকাশিত যে, বাঙালীদের বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করতে সহজেই অনুপ্রাণিত করতে সাহায্য করে।

■ উপসংহার:- বাংলাভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার অসীম গুরুত্বকে অনুভব করে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ -এর ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ নানা তথ্য দিয়ে চেতনার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, আজও আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভীতির বিফলতা দূরীকরণ না হয়ে বাংলাভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার বড় অন্তরায় হল, উপযুক্ত পুরস্তক রচনার অভাব, আর এই অভাবের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরাজী বা জার্মান ভাষায় উন্নত বিজ্ঞান গ্রন্থের তর্জমা করতে গিয়ে অনেক সময় পরিভাষা তৈরী করা নাকি সহজসাধ্য হচ্ছেনা।

কিন্তু এই দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে যদি বিজ্ঞানীমনস্ক ব্যক্তিগণ পরিভাষা সৃষ্টির জন্য আত্মনিয়োগ করেন তাহলে এই সমস্যার সমাধানকল্পে রচিত পুস্তকগুলির সাহায্যে বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথ সুগম হবে এবং বাংলাভাষাতে বিজ্ঞানের গবেষণা প্রসূত পথ ধরে বাঙালী তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে “জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসন লবে।” এই কারণে যে, বিজ্ঞানের অন্দরমহলে প্রবেশের মাপকাঠি মাতৃভাষা তথা বাংলাভাষার। অতএব বিজ্ঞানকে গণমুখী করে গড়ে তোলার প্রয়োজনে আগামী দিনের গবেষক, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের শিক্ষক ও অধ্যাপকদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে উপযুক্ত গ্রন্থরচনার মাধ্যমে।