জনজীবনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা | Role of Film in Public Life Essay in Bengali
[প্রবন্ধ- সংকেত:: ভূমিকা | আবিষ্কার | বর্তমানরূপ | প্রভাব | উদাহরণ | উপসংহার]
■ ভূমিকা:- লোকশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম মঞ্চাভিনয় প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। প্রাচীন ভারতের নাট্যশাস্ত্রেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীনকালের নাট্যধারায় মধ্যযুগের নাট্যাভিনয় বাংলায় সর্বপ্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৭৯৪ সালে ২৫ নং ডোমতলা লেনে। তারপর থেকে বাংলায় নাট্য রচনারীতি ও অভিনয়ের রীতি শুরু হয় , প্রাচ্য নাটক এবং পাশ্চাত্ত্য নাটককে অনুসরণ করে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের মঞ্চাভিনয় আধুনিক রূপে প্রকাশিত হল চলচ্চিত্র রূপে।
■ আবিষ্কার:- ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংরেজ বিজ্ঞানী Alfa Edition ‘Cinematograph’ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ছবিকে চলমান অবস্থায় দেখানো যায়। পরবর্তীকালে আমেরিকা ও ফরাসী বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় চলচ্চিত্র রূপ পায় নির্বাকরূপে। বিংশ শতাব্দীতে চলচ্চিত্র সবাকরূপে আত্মপ্রকাশ করে। চলচ্চিত্র বা সিনেমার প্রথম রূপ ছিল সাদা-কালো। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকান বিজ্ঞানী Eastman রঙীন ছবি আবিষ্কার করেন। এই ক্রমোন্নতির পথে চলচ্চিত্র অগ্রসর হতে থাকে। আদিযুগে চলচ্চিত্র ছিল সীমিত যন্ত্র নির্ভরশীল। অতীতের সমান্যতম ক্যামেরা এখন উন্নত পর্যায়ে আবিষ্কৃত হয়েছে। শব্দ সংযোজন ও নিত্যনতুনভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
■ বর্তমান রূপ:- বর্তমানের চলচ্চিত্র যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়েছে। যন্ত্রের অভিনব সংযোজনে চিত্রগ্রহণ, শব্দ যোজনা, সম্পাদনা, ডাবিং প্রভৃতি মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে। যন্ত্রের সাহায্যে অভিনব সেট-সেটিং তৈরী করে নানা কলাকৌশল পরিবেশে অভিনেতা / অভিনেত্রীদের অভিনয় করতে হচ্ছে মানবহৃদয়ে মোহ সৃষ্টি করার জন্য।
■ প্রভাব:- প্রাত্যহিক জীবনে বিপর্যস্ত মানুষ জীবন সংগ্রামের স্মৃতিকে সাময়িক লাঘব করতে, কিংবা কয়েকঘণ্টা মানসিক কষ্ট ভুলে থাকার জন্য ঘুরে আসে সিনেমা হলের মধ্যে প্রদর্শিত চিত্র দেখে, সাময়িক সুখ লাভ করে কুহেলিকাময় কল্পনা রাজ্যের প্রভাবে। সুস্থসুন্দর চলচ্চিত্রের প্রভাব মানব জীবনে সর্বদাই শুভ। সুস্থ চলচ্চিত্র একদিকে যেমন মানষকে আনন্দ দান করে, অপরদিকে তাকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে সাহায্য করে। অনেক অজানা বস্তু বা দৃশ্যের সন্ধান সহজে একমাত্র চলচ্চিত্রই প্রদান করতে পারে। যেমন- বিশ্বের সমস্ত দেশকে দেখার সুযোগ সব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়না। এছাড়া নানা দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনধারা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, অতীতের সদ্ধের দৃশ্য ইত্যাদি সহজেই এবং স্বল্প খরচে দৃষ্টিগোচর একমাত্র চলচ্চিত্রই দিতে পারে।
এই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারে। চলচ্চিত্র আবার শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় মানুষকে বিকৃত পথেও চালিত করে। অশ্লীল চলচ্চিত্র জাতীয় জীবনে যে কতখানি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তা বেশ আতঙ্কজনক। যেমন— নায়ক বা নায়িকার বেশভূষা, কথাবার্তা, চালচলনকে অনুকরণ করছে আজকের যুব সমাজ। ফলে তারা তাদের মানসিক বিকাশকে উন্নত করার বদলে অবনতির পথেই এগিয়ে নিয়ে চলছে। আবার অশ্লীল যৌনচিত্র, আবেগ প্রধান দৃশ্য কিশোর কিশোরীদের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে তাদের অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা দুপুরকালীন প্রদর্শিত চিত্র দেখতে গিয়ে তাদের ভবিষ্যতের উন্নতির সোপান বিদ্যার্জনকে সাময়িক আবেগ মেটাতে গিয়ে তা ভেঙে ফেলছে। এইভাবে কুরুচিকর চলচ্চিত্র সমাজজীবনকে কলুষিত ও বিপথগামী করে তুলছে।
■ উদাহরণ:- বিশ্বের চলচ্চিত্র তথা কলকাতার চলচ্চিত্র জগৎ অতীতে এমন অনেক উপহার দিয়েছে, যা মানুষকে দিয়েছে একদিকে তাপার আনন্দ অপরদিকে গভীর আদর্শের সন্ধান। কলকাতায় তৈরী এমন সব ছবির মধ্যে উল্লেখাযোগ্য হল— ‘বিদ্যাপতি’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘অশনি সংকেত’, ‘ভুলি নাই’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘সুভাষচন্দ্র’, ‘নীলদর্পণ’, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’, ‘মহাকবি গিরীশচন্দ্র’, ‘গণদেবতা’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি। বিশ্বের দরবারে ইংরাজী ভাষায় নির্মিত ‘BENHOOR’, ‘GUNS OF NAVARONG’, ‘GOD FATHER’, ‘TITANIC’ ইত্যাদি অবিস্মরণীয় চিত্র। বিগত কয়েক দশক ব্যাপী অশ্লীল চিত্র যেভাবে নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে যে তার প্রভাব সু – আদর্শ মানুষ সমাজে লুপ্ত হতে চলেছে। সেই সব ছবির নাম উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
■ উপসংহার:- শিল্পের মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব প্রযোজক চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁরা কখনো আর্থিক সাফল্য কিংবা অসাফল্য সম্বন্ধে চিন্তা করতেন না। তাঁরা ছিলেন প্রকৃত চলচ্চিত্রের স্রষ্টা। অপরদিকে আর্থিক দিককে সামনে রেখে এক শ্রেণীর নির্মাতা তার মুনাফা লাভ করার জন্য শুভ বুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে কুরুচিপূর্ণ ছবি তৈরী করতে প্রয়াসী হয়েছে। তার ফলে আজকের জাতীয় জীবন ধীরে ধীরে পঙ্গু হতে চলেছে।
যে চলচ্চিত্র জাতীয় জীবনকে গড়তে পারে, সেই ছবিই আবার কুরুচিতে আসক্ত হয়ে সামাজিক মূল্যবোধকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। চলচ্চিত্রই ভারতীয় সনাতনকে লুপ্ত করে বিদেশী প্রভাব কিশোর – কিশোরীদের আকৃষ্ট করছে। বিশেষভাবে তারা আগ্রহী হচ্ছে সস্তা আমোদ-প্রমোদ, ভাড়ামি, মারপিট, কুৎসিৎ অঙ্গীভঙ্গীতে, নাটক, নাচগান এবং রোমান্টিক দৃশ্যগুলিতে। তাই চলচ্চিত্রকে জাতীয় জীবনে অতিশয় গভীর প্রভাবকে স্মরণ রেখে দর্শক সমাজ, জনকল্যাণমুখী সংস্থা ও Central Board of Cinema Cerification -কে সতর্ক হতে হবে। তাহলেই বন্ধ হবে অশ্লীল চিত্র নির্মাণ। যার ফলে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় আগামী দিনে সিনেমা হলে অশ্লীল চিত্রের প্রদর্শন এবং কিশোর-কিশোরী দর্শকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। যার সংক্ষেপ ফলাফল— সর্বনাশ, তথা যুব সমাজের অবক্ষয়।