ভারতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার | Role of Election Commission in India

ভারতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার | Role of Election Commission in India

■ প্রশ্ন:- ভারতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার মূল্যায়ন করো | Role of Election Commission in India

উত্তর:- ভারতের নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবুও একেবারে ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা যায় নি। এক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থাদির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি বর্তমান।

■ (১) কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতা ও কার্যকাল সম্পর্কে সংবিধান নীরব:- সংবিধানে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা ও কার্যকাল সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। বলা হয়েছে যে, পার্লামেন্টে আইন প্রণীত হওয়া পর্যন্ত এগুলি রাষ্ট্রপতির দ্বারা স্থিরীকৃত হবে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী কার্যক্ষেত্রে কেন্দ্রই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে এ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে শাসকদল ক্ষমতার কোন অপব্যবহার করে নি। সব সময় গুণগত যোগ্যতার বিচারে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের এই পদে নিযুক্ত করা হয়েছে।

■ (২) মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের উপর সরকারের প্রভাব:- মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের চাকরির শর্তাদি রাষ্ট্রপতিই ধার্য করেন। বর্তমানে তিনি ছ’বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। তাঁর কার্যকাল বৃদ্ধি করা হবে কিনা তা রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের উপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এবং তাঁর নিরপেক্ষতা নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বর্তমান। অনেকের মতে বহুক্ষেত্রেই কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে।

■ (৩) অবসর গ্রহণের পর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে অন্য কোন পদ প্রদান অনুচিত:- অবসর গ্রহণের পর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে অন্য পদে নিয়োগ করা যায়। এ ব্যাপারে সংবিধানের কোন বাধা-নিষেধ নেই। এই অবস্থায় ভবিষ্যতে সরকারী অনুগ্রহ লাভের আশায় মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার তাঁর কাজকর্মের মাধ্যমে সরকারকে সতত সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ অবসরপ্রাপ্ত অবস্থায় চাকরির লোভ কম নয়। সুতরাং সরকারী অনুগ্রহ লাভের বাসনা যদি মনের মধ্যে থাকে তা হলে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সব সময় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলবেন সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে না।

■ (৪) কমিশনের নিজস্ব কর্মচারীমণ্ডলী নেই:- নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোন কর্মচারীমণ্ডলী নেই। এ ব্যাপারে কমিশনকে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের উপর নির্ভর করতে হয়। সংবিধানের ৩২৪(৬) ধারা অনুসারে এক্ষেত্রে সাহায্য লাভের নিশ্চয়তা আছে। একথা ঠিক, তবুও বিশেষ প্রয়োজনের সময় কমিশনকে অসুবিধায় পড়তে হতে পারে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন, সুপ্রীম কোর্ট প্রভৃতি সংস্থার হাতে এ ক্ষমতা আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে এ ক্ষমতা দেওয়া হয় নি।

■ (৫) নির্বাচনের প্রাক্কালে আইন:-শৃঙ্খলার উপর কমিশনের হাত নেই:- নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের। এ ব্যাপারে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কোন ক্ষমতা নেই। কিন্তু রাজ্যের পুলিশ বা অন্যান্য অসামরিক বাহিনী নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সব সময় তাদের দায়িত্ব পালন করে না। তাই নির্বাচনে প্রায়ই প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও কারচুপির অভিযোগ শোনা যায়।

■ (৬) জোহারীর আশঙ্কা:- কোন অঙ্গরাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন এক বছরের অধিক বলবং রাখার ক্ষেত্রে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সম্মতিতে কাজ হয়। সংবিধানের ৪৪ তম সংশোধনে (১৯৭৮) এ রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৪৪ তম সংশোধনী আইনের এই বিধান মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে দেশের রাজনৈতিক জটিলতার সামিল করতে পারে। অধ্যাপক জোহারী এ ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

■ (৭) অযুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি:- নির্বাচন কমিশন গঠন ও পরিচালনার ব্যাপারে অঙ্গরাজ্যের কোন ভূমিকা নেই। অনেকের মতে এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

■ (৮) কমিশনের পরামর্শ মানতে কেন্দ্র বাধ্য নয়:- কমিশনের সুপারিশ ও পরামর্শ গ্রহণ করতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোকসভার সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি না করার ব্যাপারে কমিশন পরামর্শ দিয়েছিল। কমিশনের এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সাধারণত কমিশনের সুপারিশ শাসকদলের স্বার্থের অনুকূলে হলে কেন্দ্রীয় সরকার তা স্বীকার ও কার্যকর করে। অন্যথায় অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করে।

■ (৯) শাসকদলের বিরূপ মন্তব্য:- বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, জালভোট, নির্বাচনকেন্দ্র দখল, দুর্নীতি প্রভৃতি প্রতিহত করে কমিশন নির্বাচন-ব্যবস্থাকে ত্রুটি মুক্ত করতে পারে নি।

■ (১০) সরকারের সমালোচনা:- আবার সাম্প্রতিককালে কমিশনের কিছু সঠিক সিদ্ধান্তকেও ক্ষমতাসীন সরকারী পক্ষ সমালোচনা করেছেন এবং কমিশনের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করার কথা বলেছেন।

■ (১১) রাজনীতিক উদ্দেশ্য:- অনেকের মতানুসারে নির্বাচনের দিন ঘোষণা, নির্বাচন স্থগিত রাখা সম্পর্কিত কমিশনের কোন কোন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কমিশন এ রকম অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক চাপের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সমালোচকদের মতানুসারে এইভাবে নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে থাকে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সংগঠন ও ভূমিকার মূল্যায়ন করে অধ্যাপক মাহেশ্বরী সুপ্রীম কোর্ট, রাষ্ট্রকৃত্যক, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক এবং নির্বাচন কমিশন — ভারতীয় গণতন্ত্রের এই চারটি স্তম্ভের মধ্যে শেষেরটিকে দুর্বলতম (Weakest Pillar of our Democracy) বলে অভিহিত করেছেন। তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবী ক্রমশ জোরদার হচ্ছে।

■ উপসংহার:- সংবিধান অনুসারে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে নির্বাচন পরিচালনার প্রাথমিক দায় কেন্দ্রের। নির্বাচন কমিশন গঠন, এলাকা নির্ধারণ প্রভৃতি কাজের ভার কেন্দ্রের উপর ন্যস্ত আছে, রাজ্যের উপর নয়। পার্লামেন্ট কেন্দ্র ও রাজ্যের আইনসভার নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। তবে রাজ্যের আইনসভায় নির্বাচনের ব্যাপারে পার্লামেন্টের কোন আইন না থাকলে রাজ্যের আইনসভা আইন প্রণয়ন করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব রাজ্যগুলির উপর ন্যস্ত আছে, জাতীয় সরকারের উপর নয়। অনেকের মতে মার্কিন ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু এই ব্যবস্থায় নির্বাচনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে ভারতীয় ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির অনুপন্থী না হলেও, জাতীয় সংহতির উপযোগী।