সাম্যের অধিকার বলতে কি বোঝো, ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকার | Right to Equality of Indian Constitution

সাম্যের অধিকার বলতে কি বোঝো, ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকার | Right to Equality of Indian Constitution

■ প্রশ্ন:- সাম্যের অধিকার বলতে কি বোঝো? ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো। (Right to Equality of Indian Constitution).

উত্তর:- সাম্যের ধারণা– সাম্য হল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আদর্শ। তত্ত্বগত ধারণা অনুসারে সাম্য বলতে সকলের ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ও সমানুপাতিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাকে বোঝান হয়। সকলের সুপ্ত গুণাবলী ও ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার স্বীকৃতিকে সাম্য বলে। ব্যাপক অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবরকম বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার স্বীকৃতি। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সকলের জন্য সমান মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধার সমতা প্রতিষ্ঠার সাধু সংকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এই সংকল্পকে বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে সংবিধানের ১৪-১৮ ধারায় নাগরিকদের জন্য সাম্যের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

‘আইনের দৃষ্টিতে সাম্য’ ও ‘আইনের সমান সংরক্ষণ’:- সংবিধানের ১৪ নং ধারায় সকল ব্যক্তির জন্য ‘আইনের দৃষ্টিতে সাম্য’ (Equality before the law) অথবা ‘আইনের সমান সংরক্ষণের’ (Equal protection of the laws) অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্র কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই দু’টি অধিকার অস্বীকার করতে পারবে না। উল্লিখিত অধিকার দু’টির প্রথমটি ব্রিটেনের প্রথাগত আইন এবং দ্বিতীয়টি মার্কিন সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুব্বারাওয়ের মতানুসারে প্রথমটি নেতিবাচক এবং দ্বিতীয়টি ইতিবাচক। ‘আইনের দৃষ্টিতে সাম্য’ -এর ধারণা ডাইসির অনুশাসন তত্ত্বের অনুসরণে রচিত। এই তত্ত্বের দ্বিতীয় অনুমান অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তিই সমানভাবে আইনের অনুগত। মর্যাদা ও অবস্থা নির্বিশেষে কোন ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের দরিদ্রতম সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সকলেই দেশের সাধারণ আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সাধারণ আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত।

সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সমতার কতকগুলি ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে।

● (১) সংবিধানের ৩৬১ ধারায় দু’ -একটি গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। (ক) রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল তাঁদের ক্ষমতা, প্রয়োগ ও কর্তব্য সম্পাদনের জন্য আদালতের কাছে জবাবদিহি করবেন না। (খ) পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা এবং তাঁদের গ্রেপ্তার বা আটক করা যাবে না। (গ) তাঁদের বিরুদ্ধে দেওয়ানী মামলা দায়ের করা যাবে বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে পূর্বাহ্ণে দু’মাসের নোটিশ দিতে হবে।

● (২) ভারতীয় ফৌজদারী দণ্ডবিধির ১৯৭ ধারা অনুসারে কোন সরকারী কর্মচারী কর্তব্য পালনের সময় কোন ফৌজদারী অপরাধ করলেও রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের অনুমতি ব্যতিরেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় না।

● (৩) বিদেশী শাসক রাষ্ট্রদূতগণ ভারতীয় আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুসারে এই সৌজন্যমূলক ব্যতিক্রম সকল সভ্য দেশেই মেনে চলা হয়।

● (৪) প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী মামলা দায়ের করতে হলে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের পূর্বানুমতি লাগে।

● আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার:- এই অধিকারের অর্থ হল সমান। অবস্থার এবং সমান পর্যায়ের ব্যক্তিদের জন্য একই আইন থাকবে এবং তা সমান আচরণ করবে। একই অবস্থায় অবস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে রাষ্ট্র কোন বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না।

■ শ্রেণীবিভাজনের অর্থ ও প্রকৃতি:- আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার বলতে সকলের জন্য সমান অধিকার বোঝায় না। অবস্থা ও পর্যায়ের বিভিন্নতা থাকলেই আইনও বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। রাষ্ট্র যুক্তিসঙ্গত ভিত্তিতে ব্যক্তির শ্রেণীবিভাগ করে বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করতে পারে বা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পৃথকীকরণ করতে পারে (চিরঞ্জিতলাল চৌধুরী বনাম ভারত সরকার ও অন্যান্য, ১৯৫১)। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বনাম আনোয়ার আলি মামলায় সুপ্রীমকোর্টের রায় অনুসারে

● (১) শ্রেণীবিভাগটি সুস্পষ্ট এবং সহজবোধ্য হবে এবং

● (২) শ্রেণীবিভাগের সঙ্গে আইনের উদ্দেশ্যের যুক্তিপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। ১৪ নং ধারার অধিকারটি পুরোপুরি আইনগত। তাছাড়া এই ধারায় উল্লিখিত বিধিনিষেধসমূহ কেবলমাত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য, ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়।

■ বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ:- সংবিধানের পরের ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কেবলমাত্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান, স্ত্রী-পুরুষভেদে বা তাদের কোন একটির ভিত্তিতে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না [১৫ (১) ধারা]। আবার কেবলমাত্র উল্লিখিত কারণগুলির বা তাদের কোন একটির জন্য কোন নাগরিককে দোকান, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য রেস্তোরাঁ, হোটেল ও প্রমোদস্থানে প্রবেশের ক্ষেত্রে এবং সরকারী অর্থে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে পরিচালিত কূপ, জলাশয়, স্নানাগার, পথ ও সমাগম স্থান ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ বা অসামর্থ্য আরোপ করা যাবে না [১৫ (২)] ধারা। এই ধারায় প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা ও জাত-পাতের মানসিকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এই অধিকারটি একই সঙ্গে ‘রাষ্ট্র’ ও ‘ব্যক্তি’ উভয়ের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হবে।