রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মন্ত্রিসভার সম্পর্ক আলোচনা করো | Relationship Between President and Cabinet

■ প্রশ্ন:- রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মন্ত্রিসভার সম্পর্ক আলোচনা করো। (Relationship Between President and Cabinet)
অথবা, মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুসরণ করা কি তার পক্ষে বাধ্যতামূলক?

উত্তর:- ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির প্রকৃত ভূমিকা ও পদমর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। তাই এ বিষয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সম্পর্ক আলোচনা করলে রাষ্ট্রপতির শাসনতান্ত্রিক ভূমিকা ও পদমর্যাদার পরিচয় পাওয়া যায়। বাস্তববাদী সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের (Political school) মতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ব্রিটেনের রাজা বা রানীর ন্যায় একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান মাত্র। অপরপক্ষে তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী বিশেষজ্ঞদের (Legal school) মতানুসারে রাষ্ট্রপতিই দেশের প্রকৃত শাসক প্রধান।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মন্ত্রিসভার সম্পর্ক আলোচনা করো | Relationship Between President and Cabinet

■ (১) মন্ত্রিসভা শাসনকার্য পরিচালনা করে:-

বাস্তববাদী বিশেষজ্ঞদের মতে, শাসনতন্ত্রের বিধিবদ্ধ নিয়মকানুনের সঙ্গে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতিকে যুক্ত করে বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। তাহলে শাসনব্যবস্থার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাবে। ব্রিটেনের মতো ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ (৩) ধারায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে লোকসভার কাছে দায়িত্বশীল করা হয়েছে। লোকসভার কাছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এই দায়িত্বশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে , সংবিধান মন্ত্রিসভাকেই প্রকৃত ক্ষমতার কর্ণধার করেছে।

■ (২) রাষ্ট্রপতি সংবিধান মেনে চলতে বাধ্য:-

সংবিধানের ৫৩ (১) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি তাঁর শাসনসংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা সংবিধান অনুসারে প্রয়োগ করতে বাধ্য। শ্রীঅশোক চন্দ্রের মতানুসারে ১৯৩৫ সালে ভারতশাসন আইনের গভর্ণর জেলারেলের পদকে অনুসরণ করে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা স্থির করা হয়েছে। কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে গভর্ণর, জেনারেলের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয় নি ।

■ (৩) সংবিধানের ৭৪ (১) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি একটি মন্ত্রিসভা গঠন করতে বাধ্য। রাষ্ট্রপতি খুশিমত যে-কোন মন্ত্রিসভা গঠন করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন না। কারণ- মন্ত্রিসভার সদস্যদের সংসদের সদস্য হতে হয় এবং লোকসভার কাছে দায়ী থাকতে হয়। তবে সংসদের সদস্য না হয়েও ছ’মাস মন্ত্রিসভায় থাকা যায়। আবার পার্লামেন্টের বিশেষজ্ঞ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করতে হয়। তা না হলে শাসনতান্ত্রিক সংকটের সৃষ্টি হবে।

■ (৪) রাষ্ট্রপতিকে মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে হয়। সংবিধানের ৪২ এবং ৪৪ তম সংশোধনের পর রাষ্ট্রপতির নিজস্ব বিবেচনা অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনার আর সুযোগ নেই। সংশোধিত ৭৪ (১) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে বাধ্য। তাছাড়া সংবিধানে রাজ্যপালের হাতে যেমন কিছু স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে , রাষ্ট্রপতির হাতে তেমন কোন ক্ষমতা দেওয়া হয় নি।

■ (৫) স্বেচ্ছায় কাজ করার সুযোগ নেই:-

শ্রীআম্বেদকরের মতে, রাষ্ট্রপতি লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট মন্ত্রিসভার পরামর্শ অগ্রাহ্য করতে কার্যক্ত পারেন না। পরামর্শ অগ্রাহ্য করলে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে। তখন রাষ্ট্রপতিকে আরেকটি মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। কিন্তু আগের মন্ত্রিসভার পিছনেই লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন ছিল। তাই সংবিধানসম্মত আরেকটি মন্ত্রিসভা গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। আর লোকসভা ভেঙে নতুন নির্বাচন করার রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়া বিজ্ঞজনোচিত কাজ হবে না। তাছাড়া অবস্থা অনুকূল হলে মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের চেষ্টাও করতে পারে।

■ (৬) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রিসভা, রাষ্ট্রপতি অবহিত হন:-

সংবিধান অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার সকল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রিসভা, রাষ্ট্রপতি নয়; রাষ্ট্রপতি সে-বিষয়ে অবহিত হতে পারেন মাত্র।

■ (৭) রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থার ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে:-

অধ্যাপক এম.পি শর্মার মতানুসারে জরুরী অবস্থাতেও রাষ্ট্রপতিকে মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে কাজ করতে হয়। সংবিধানের ৪৪ তম সংশোধনে রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতাকে বিভিন্নভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার প্রস্তাবের লিখিত অনুলিপি ছাড়া জরুরী অবস্থা জারী করতে পারেন না। কেবল সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণেই আভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা যায়। ঘোষণার একমাসের মধ্যে সংসদের উভয় কক্ষের উপস্থিত সদস্যের % অংশের দ্বারা অনুমোদিত হলে জরুরী অবস্থা ছ’মাস চালু থাকতে পারে। তারপরে চালু রাখতে গেলে অনুমোদনের দরকার হয়। লোকসভা যে-কোন সময় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থনে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাশ করতে পারে। তখন রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য।

■ (৮) সামরিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ:-

সামরিক ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিতান্তই সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতা সংসদীয় আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিটি (National Defence Committee) -র সিদ্ধান্ত মত তাঁকে সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে লাহোর ফ্রন্টে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রসরের ঘটনা রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণাণের জানা ছিল না।

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে রাষ্ট্রপতি একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক মাত্র, সকল ক্ষেত্রে তিনি মন্ত্রিসভার পরামর্শমত চলতে বাধ্য। সুপ্রীম কোর্টও আর জে.কাপুর বনাম পঞ্জাব সরকার (১৯৫৫), ইউ.এন.রাও বনাম ইন্দিরা গান্ধী (১৯৭১), শামসের সিং বনাম পঞ্জাব সরকার (১৯৭৪) প্রভৃতি মামলায় এই মতকে সমর্থন করেছে।