আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিবাদী | Realist Visionary of International Relations

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী দৃষ্টিবাদী | Realist Visionary of International Relations

■ প্রশ্ন:- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চর্চায় বাস্তবতাবাদের প্রধান সূত্রগুলি আলোচনা করো।অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনায় বাস্তববাদী দৃষ্টিবাদী ব্যাখ্যা করো।

উত্তর:- ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিশ্লেষণ:- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুশীলনের ক্ষেত্রে বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রাধান্য অনস্বীকার্য। বাস্তববাদী তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুসারে ‘ক্ষমতাই হল রাজনীতির মূল’। সকল রাজনীতির মূল কথা হল ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম। অনুরূপভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও হল ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম। সাধারণভাবে ক্ষমতা বলতে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ককে বোঝায়। এই সম্পর্কের মাধ্যমে একটি পক্ষ অন্যপক্ষের আচার – ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।

■ স্বার্থসাধনের জন্য ক্ষমতা:- বাস্তববাদী তত্ত্বের দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় ধারণা হল ‘স্বার্থ’। বাস্তববাদী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক – বিজ্ঞানীরা ‘ক্ষমতা’ র পরিপ্রেক্ষিতে ‘স্বার্থে’ র ধারণাটি পর্যালোচনা করার পক্ষপাতী। এইভাবে বাস্তববাদীরা ‘ ক্ষমতা ও স্বার্থের মধ্যে পার্থক্যকে অপসারিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। এ ব্যাপারে হ্যানস্ মরগেনথাউ -এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করার অর্থ নিজের স্বার্থে কাজ করা। এই উদ্দেশ্যে ক্ষমতার জন্য অনুসন্ধান ও উদ্যোগ স্বাভাবিক। সুতরাং অন্যান্যদের নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা ও শক্তি-সামর্থ্য থাকা দরকার। মানুষের প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান উপাদান বা শক্তিসমূহের অভিব্যক্তিই হল এই বাস্তববাদিতা । এই মতবাদের প্রবক্তাদের মতানুসারে মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। স্বীয় স্বার্থ সাধনের জন্য মানুষ ক্ষমতা অর্জনে আগ্রহী হয়।

■ মূল বক্তব্য:- বাস্তববাদী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহই হল মুখ্য কর্মকর্তা। রাষ্ট্র মাত্রেই স্বীয় সর্বাধিক জাতীয় স্বার্থ সাধনের ব্যাপারে সর্বতোভাবে সক্রিয় হয়। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিকেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জাতির সামরিক শক্তিকে জাতীয় স্বার্থ সাধনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয়। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় শক্তিকেন্দ্রিক ভারসাম্য মূলক হাতিয়ারের মাধ্যমে। বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রধান প্রেরণামূলক উপাদান হল জাতীয় স্বার্থের বিচার-বিবেচনা।

■ মতবাদটির উৎস:- বাস্তববাদী মতবাদের উৎপত্তির ইতিহাস আজকের নয়, অনেক দিনের। হেগেল, হস ও ম্যাকিয়াভেলীর রাষ্ট্রদর্শনে বাস্তববাদী চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া। এ প্রসঙ্গে আর যে সমস্ত চিন্তাবিদের নাম উল্লেখ করা আবশ্যক তাঁরা হলেন বারট্রান্ড রাসেল, ই.এইচ.কার, মার্টিন রাইট, ফ্রেডারিক স্যুম্যান, নিকোলাস স্পাইকম্যান, জর্জ.এফ.কেন্নান এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যান্য রাষ্ট্রদার্শনিক। তবে হ্যানস্ মরগেনথাই -এর হাত ধরেই মতবাদটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনুশীলনের ইতিহাসে বিশেষ -প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে বাস্তববাদী মতবাদটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব লাভ মরগেনথাউ -এর বাস্তববাদী তত্ত্বঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা-অনুশীলনের ক্ষেত্রে একটি অর্থবহ মতবাদ প্রয়োগের ব্যাপারে মরগেনথাউ বিশেষভাবে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেন।

বাস্তববাদী তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর উদ্দেশ্য হল এই তাত্ত্বিক কাঠামোর সাহায্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন ঘটনাবলীর সুশৃঙ্খল বিন্যাসের মাধ্যমে অভিন্ন অর্থ উপস্থাপিত করা। এ প্রসঙ্গে মরগেনথাউ -এর বিখ্যাত গ্রন্থ Politics Among Nations বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থে তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল ও মৌলিক বিষয়াদির অনুসন্ধান অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেছেন। মরগেনথাউ কোন তত্ত্বের যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে উদ্দেশ্যের উপরই গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। মরগেনথাউ -এর মতানুসারে ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র স্বার্থের ধারণার ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এবং আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করা যায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাক্ষেত্রের সীমানা নির্ধারণ, বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিক সূচক বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক সমাজের অধিকাংশ বিষয়াদির মধ্যে সংহতি সাধন এই একটি মাত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সম্ভব। মরগেনথাউ -এর বাস্তববাদী তত্ত্ব অভিজ্ঞতাবাদী। মরগেনথাউ ছ’টি মৌলিক নীতির ভিত্তিতে রাজনীতিক বাস্তবতার বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এই ছ’টি নীতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।

■ প্রথম নীতি:- রাজনীতিক বাস্তববাদ অনুযায়ী কিছু বিষয়গত বিধি-ব্যবস্থার দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হয়। মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই এই সমস্ত বিধি-ব্যবস্থার উৎস বর্তমান। এই সমস্ত বিষয়গত বিধি-ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। সমাজব্যবস্থায় যথাযথ বিকাশ সাধন ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে এটা দরকার। এই সমস্ত বিষয়গত বিধি ব্যবস্থার সাহায্য-সহযোগিতা ব্যতিরেকে জাতীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত কোন তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব। সুতরাং সমাজের সুপরিচালনা এবং যুক্তিসঙ্গত তাত্ত্বিক কাঠামো — এই দু’দিক থেকেই অপরিহার্য হল সেই সমস্ত বিষয়গত বিধি ব্যবস্থা যেগুলি মানব প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজনীতিক বাস্তববাদ অনুসারে রাজনীতিতে সত্য ও মতের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সত্যের মধ্যে বিষয়নিষ্ঠতা ও যুক্তিসঙ্গততা ঘটনাসমূহ ও যুক্তির দ্বারা সমর্থিত হয়।

অপরদিকে মত হল সমর্থনহীন অন্তঃসারশূন্য মতবাদ। মতের মধ্যে আছে সংস্কার ও কল্পনাবিলাস। রাজনীতিক বাস্তবাদে অবাস্তব মতের জায়গা হয় না। রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা নির্ধারিত হয় বাস্তব ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে। বাস্তব বা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যে সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বা কাজকর্ম পরিচালনা করে তদনুসারে। বৈদেশিক নীতির চেহারা-চরিত্র নিরূপিত হয়। মুখ্য বিচার্য বিষয় হল রাজনীতিকরা বিভিন্ন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কি করেন বা কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্যাদি ও ঘটনাবলীকে অর্থবহ করে তোলা আবশ্যক। এই উদ্দেশ্যে যুক্তিগ্রাহ্য একটি কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। এই কাঠামোর ভিত্তিতে রাজনীতিক বাস্তবতার বিচার-বিবেচনা করা সম্ভব হবে।

■ দ্বিতীয় নীতি:- জাতীয় স্বার্থ নির্ধরিত হয় ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে। এবং রাষ্ট্রনেতারা প্রভাবিত হন এই জাতীয় স্বার্থের দ্বারা। যুক্তি ও ঘটনার মধ্যে সংযোগ অব্যাহত থাকে জাতীয় স্বার্থের ধারণার মাধ্যমে। আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনীতি অনুধাবনের ক্ষেত্রে এই জাতীয় স্বার্থের ধারণা সাহায্য করে। জাতীয় স্বার্থের ধারণা আলোচিত হয় রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে। এই ধারণাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করেছে রাজনীতিক বাস্তবতাকে। রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক তথ্যাদির মধ্যে তারতম্য বর্তমান। জাতীয় স্বার্থের ধারণা ব্যতিরেকে এই তারতম্য অনুধাবন অসম্ভব।

আধুনিক কালের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সাধারণ রূপরেখা নির্ধারিত হয় জাতীয় স্বার্থের বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা না থাকলে অ-রাজনীতিক কার্যকলাপ থেকে রাজনীতিক কার্যকলাপকে আলাদা করা অসম্ভব হয়ে পড়ত। ক্ষমতার ধারণার থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে স্বতন্ত্র করা সম্ভব নয়। কারণ জাতি-রাষ্ট্রসমূহের বিশ্বাস অনুসারে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ক্ষমতা অর্জন অপরিহার্য। রাজনীতিক বাস্তববাদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তব চিত্র পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে সম্যকভাবে প্রতিফলিত হয়। বাস্তবে প্রয়োগ করার সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিবাদিতাও বৈদেশিক নীতির মধ্যে থাকা দরকার। পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে রাজনীতিক সহানুভুতি বা দার্শনিক চিন্তাধারার অস্তিত্বের কোন রকম সম্ভাবনা থাকে না। মর্গেনথাউ -এর মতানুসারে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নৈতিক আদর্শ বা সৎ উদ্দেশ্য নিতান্তই গুরুত্বহীন।

■ তৃতীয় নীতি:- জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের ধারণা সম্পর্কযুক্ত। দেশের বৈদেশিক নীতি জাতীয় স্বার্থের ধারণা থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন হয় না। রাজনীতির নির্যাস নিহিত আছে স্বার্থের ধারণার মধ্যে। পররাষ্ট্রনীতি প্রণীত হয় রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের মধ্যে। এর উপরই স্বার্থের প্রকৃতি নির্ভরশীল। অনুরূপভাবে রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের উপর নির্ভরশীল থাকে ক্ষমতার বিষয়বস্তু এবং তার প্রয়োগ পদ্ধতি। ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে স্বার্থকে বিশ্লেষণ করা হয়। এই স্বার্থই পররাষ্ট্রনীতির সাধারণ রূপরেখা নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক ও আনুষঙ্গিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতার ধারণাটি পর্যালোচনা করা হয়। অনুরূপভাবে রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে স্বার্থ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। পররাষ্ট্রনীতি স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ কথা ঠিক তবে সমাজজীবনের বিভিন্ন দিকে ও পর্যায়ে সংঘটিত পরিবর্তনসমূহও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনা করা হয়।

■ চতুর্থ নীতি:- ব্যক্তিগত জীবনে ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণের ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতি ও আদর্শের মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না। স্বভাবতই ন্যায়-নীতি এবং মতাদর্শ ও মূল্যবোধের জন্য ব্যক্তি-মানুষকে ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায়। কিন্তু জাতি বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। রাজনীতিক বাস্তববাদ অনুযায়ী সার্বজনীন ন্যায়-নীতির ধারণাকে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর এক নীতি অনুসরণ করে; সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ জাতীয় স্বার্থ সাধনের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র নীতি অনুসরণ করে।