বাংলা ছোটোগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান | Rabindranath’s Contribution Bengali Short Stories

বাংলা ছোটোগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান | Rabindranath’s Contribution Bengali Short Stories

❏ প্রশ্নঃ- রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প সম্পর্কে আলোচনা কর। [অথবা] বাংলা ছোটগল্প রচনায় রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্বের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করো। (Rabindranath’s Contribution Bengali Short Stories)

উত্তর:- রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটো গল্পের প্রথম সার্থক স্রষ্টা। বঙ্কিমচন্দ্র মূলত উপন্যাসের মধ্যেই তার সাহিত্য প্রতিভা সীমিত রেখেছিলেন বলে তিনি ছোটোগল্প রচনায় মনোযোগী হননি। রবীন্দ্রনাথ গীতিকবি, গীতিকবিতার সঙ্গে ছোটোগল্পের সাদৃশ্য আছে এই কারণে যে, উভয় ক্ষেত্রেই জগৎ ও জীবনের খণ্ড রূপের মধ্যে চিত্তের মুক্তি ঘটে। তাই গীতিকবিতার সঙ্গে ছোটোগল্পের মধ্যেও রবীন্দ্রচিত্তের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তি ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ কিশোরকালে ‘ভিখারিনী’, ‘ঘাটের কথা’ ও ‘রাজপথের কথা’ নামে যে গল্পগুলি লিখেছিলেন, সেগুলি নিতান্ত কাঁচা হাতের উচ্ছাসধর্মী রচনা।

এরপর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গে জমিদারীর কার্য তত্ত্বাবধানকালে তিনি প্রথম উন্মুক্ত প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলেন, দেখলেন তাদের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা প্রেমপ্রীতি ইত্যাদি। এর ফলে খুলে গেল তার ছোটো গল্প রচনার উৎস মুখ –১৮৯১ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি রচনা করলেন অনবদ্য ছোটোগল্পগুলি।

এরপর কয়েকবছর বিরতির পর ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত আবার ছোটোগল্প রচনার জোয়ার এল। শতাধিক ছোটো গল্প রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। “রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পে মানুষ, প্রকৃতি এবং রহস্য লোকের অতিপ্রাকৃত ভাবের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। আমাদের গ্রাম ও নাগরিক জীবনের নানা ছবি, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনধরা দশা, পারিবারিক বিরোধ, স্নেহপ্রেমের সংঘাত ও সংকট, নানাধরনের ধর্মীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সংস্কারের সংজ্ঞা, মানবধর্মের বিরোধ, পরিশেষে মানবধর্মের জয় ইত্যাদি বাঙালী জীবনের নানা ধরনের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে তিনি গোটা বাঙালী জীবনকে দেখেছেন। যে জীবন কলকাতার নাগরিক জীবন হতে পারে, আবার গ্রাম্যজীবন হলেও বাধা নেই।

এই সমস্ত পারিবারিক কাহিনীতে বাস্তব পরিবেশের এমন জীবন্ত রূপ রবীন্দ্রনাথের পূর্বে আমরা আর কোথাও বড় একটা দেখিনি। ”রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গল্পগুলিতে মানবপ্রেমের বেদনামধুর সুন্দররূপ প্রকাশিত। এর মধ্যে ঘটেছে প্রেম। সৌন্দর্য ও কল্পনার বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছে। এই জাতীয় গল্পগুলি হল ‘একরাত্রি‘ দুরাসা’, ‘শেষের রাত্রি’, ‘মধ্যবাঘিনী’ ইত্যাদি। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘রাসমণির ছেলে’, ‘ছুটি’, ‘দিদি’, ‘ঠাকুর্দা’ প্রভৃতি গল্পে বাঙালী জীবনের স্নেহ প্রেমের একটা সুন্দর পারিবারিক রূপ ফুটে উঠেছে যার মধ্যে দিয়ে কবির দৈনন্দিন জীবন পরিচিতি নিবিড় মাধুর্য রসে ভরে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি গল্পে গীতিকবিতা ও অলৌকিক রহস্যলোকের সমন্বয়ে জড়জীবনের সুন্দর রম্যমূর্তি অঙ্কিত হয়েছে, সেইসঙ্গে মানবজীবনের সঙ্গে প্রকৃতির অর্ন্তগূঢ় যোগাযোগের অপূর্ব ব্যঞ্জনার আকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই জাতীয় গল্পগুলি হল ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘অতিথি’, আপদ প্রভৃতি। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ইত্যাদি আমাদের সাধারণ ভৌতিক সংস্কারের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এগুলি ঠিক ভূতের গল্প নয়। ভৌতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে মানবজীবনের অপার রহস্য, দূরাস্তৃত জীবনের অশরীরী ব্যঞ্জনা প্রভৃতি এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে যে এতে প্রাকৃত অপ্রাকৃতের ভেদ লুপ্ত হয়ে গেছে।” রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের রচিত ‘রবিবার’, ‘শেষকথা’, ‘ল্যাবরেটরী’ প্রভৃতি গল্পে আধুনিক জীবন সমস্যার বুদ্ধিদীপ্ত বিচার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনবদ্য ভাষাশৈলী তাঁর ছোটো গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন— “কিন্তু রতনের মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোস্ট আপিস গৃহের চারিদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধ করি, তাহার মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিল, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে— ”(পোস্ট মাস্টার)“ সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। তাহার পরদিন সকালেও বৃষ্টি পড়িতেছে, মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই।

কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই। ”(জীবিত ও মৃত) “ ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদুম্বরে কহিল”, মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” (ছুটি) “মোহিত আর একবার সোনার আংটির দিকে চাহিলেন এবং তার পরে যখন ধীরে ধীরে মুখ তুলিলেন তখন তাহার সম্মুখে কলংকিনী পতিতা রমনী একটি ক্ষুদ্র স্বর্ণাঙ্গুহীরের উজ্জ্বল প্রত্যয় স্বর্ণময়ী দেবী প্রতিমার মতো উদ্ভাশিত হইয়া উঠিল।” (বিচারক) রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প বিশ্বসাহিত্যেও শ্রেষ্ঠ ছোটো গল্প হিসাব স্বীকৃতি লাভ করেছে। তিনি শুধু ছোটোগল্পের সার্থক স্রষ্টা নন, ছোটোগল্পের সার্থক শিল্প রূপ সৃষ্টি করাও তার একক কৃতিত্ব।