বাংলা নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান | Rabindranath’s Contribution Bengali Drama Literature
❏ প্রশ্ন:- বাংলা নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর। (Rabindranath’s Contribution Bengali Drama Literature)
উত্তর:- সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো বাংলা নাট্যসাহিত্যও রবীন্দ্রনাথের অবদানে সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত নাট্যধারা থেকে রবীন্দ্র নাটক নানাদিক দিয়েই স্বতন্ত্র। তিনি বহিরঙ্গ নাট্যক্রিয়ার চেয়ে অন্তরঙ্গ ঘাত প্রতিঘাত ও মানসিক দ্বন্দ্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বাংলা নাটক তাঁর প্রতিভার স্পর্শে নবরূপে রসে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যে পাঠ্যনাটকের প্রবর্তক।
তাঁর নাটক বাংলা প্রচলিত নাট্যধারা থেকে স্বতন্ত্র। সেগুলি একদিকে যেমন সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ, অন্যদিকে সূক্ষ্ম নাট্য ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ায় প্রাণবন্ত। রবীন্দ্রনাথ নাটকে বাহ্যিক ঘাত – প্রতিঘাত ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি। তিনি নর – নারীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানসিক সংবেদন ও অনুভূতির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নাট্য – কাহিনীর মধ্যে তিনি চিরন্তন জীবনসত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সেই কারণে তাঁর নাটকে স্বভাবতই আবেগধর্ম কিছু বেশী। ‘বিসর্জন’ নাটকের ভূমিকায় তিনি নিজের নাটক সম্পর্কে লিখেছেন— “কেহ বলে ড্রামাটিক, বলা নাহি যায় ঠিক, লিরিকের বড় বাড়াবাড়ি।” রবীন্দ্রনাথের নাট্যসাহিত্যকে সামগ্রিকভাবে নিম্নলিখিত শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন: (১) গীতিনাট্য, (২) নাট্যকাব্য, (৩) ঋতুনাট্য, (৪) নৃত্যনাট্য, (৫) রূপক সাংকেতিক নাট্য, (৬) রঙ্গনাট্য ও (৭) সমাজনাট্য।
■ গীতিনাট্য:- রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যের মধ্যে আছে ‘রুদ্রচণ্ড’ (১৮৮১), ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১), ‘প্রকৃতির পরিশোধ’ (১৮৮৪), ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮৮) প্রভৃতি নাটক। এগুলি গীতিনাট্য হিসাবে অভিহিত। এগুলি তাঁর অল্প বয়সের রচনা। এই সকল গীতিনাট্যে প্রধানত প্রেমের সার্থকতা ও ব্যর্থতা বর্ণিত। প্রতি নাটকে একটি করে কাহিনী আছে বটে, তবে তার বিন্যাস শিথিল।
■ নাট্যকাব্য:- রবীন্দ্রনাথের নাট্যকাব্যগুলি হল ‘রাজা ও রাণী’ (১৮৮৯), ‘বিসর্জন’ (১৮৯৫), ও ‘মালিনী’ (১৮৯৬)। এই নাটকগুলি নাট্যকাব্য শ্রেণীভুক্ত। ওই সকল নাট্যকাহিনীগুলির মধ্যে কল্যাণাশ্রিত প্রেমের বিচিত্র রূপ দেখানো হয়েছে। ‘রাজা ও রাণী ’ নাটকে রাজা বিক্রম ও রানী সুমিত্রার দাম্পত্য সম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে। রানী কামনা – বাসনার পীড়ন থেকে স্বামীকে রক্ষা করতে চেয়ে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। ‘বিসর্জন’ নাটকে দেখানো হয়েছে প্রথা ও কল্যাণের দ্বন্দ্ব। রাজা গোবিন্দমাণিক্য দেবী মন্দির থেকে জীববলি নিষিদ্ধ করে দিলে রাজপুরোহিত সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করতে চেয়েছেন। এর ফলে জয়সিংহ আত্মবিসর্জন দিয়েছে। প্রথার উপর জয়ী হয়েছে প্রেম। ‘মালিনী’ নাটকে দেখানো হয়েছে রাজকন্যা মালিনীর আকস্মিক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পরিণতি, সুপ্রিয়ার অকাল মৃত্যু।
■ ঋতুনাট্য:- ঋতুনাট্যগুলি হল বাংলার বিভিন্ন ঋতুলীলাবিষয়ক। প্রকৃতির অনুপম লীলাবৈচিত্র্যকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকটি নাটকের মধ্যে সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। এই নাটকগুলি হল ‘শেষবর্ষণ’, ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘বসন্ত’, ‘সুন্দর’, ‘ফাল্গুনী’, (১৯১৬), ‘ঋতুচক্র’, ‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’। এই সকল ঋতুনাট্যের মধ্যে নিছক প্রকৃতির রূপই বর্ণিত হয়নি, এখানে প্রকৃতির রূপের মধ্যে কবি প্রকৃতপক্ষে চিরসুন্দরের লীলা প্রকাশ করতে চেয়েছেন।
■ নৃত্যনাট্য:- ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘শ্যামা’ (১৯৩৯), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৭), ‘নটীর পূজা’ (১৯২৬) —এই কয়টি নাটক নৃত্যনাট্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রধানতঃ এই সকল নাটকে নৃত্য ছন্দের মাধ্যমে এক – একটি জীবন কাহিনী রচিত। বিশ্বজীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি নৃত্যছন্দের মাধ্যমেই নিজেদের প্রকাশ করে চলেছে – নৃত্যের মাধ্যমেই জগৎ ও জীবনের অসংখ্য রূপ – বৈচিত্র্যের যথাযথ প্রকাশ সম্ভব — এই তত্ত্বটি বিভিন্ন নৃত্যনাট্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত।
■ রূপক সাংকেতিক নাটক:- রবীন্দ্রনাথের রূপক – সাংকেতিক নাটকগুলি তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই সকল নাটকে জগৎ ও জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব ও সত্যকে প্রতীকধর্মী করে প্রকাশ করা হয়েছে। নাট্যসম্রাট রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটকগুলির মধ্যে আছে ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮) ‘রাজা’ (১৯১০), ‘অচলায়তন’ (১৯১২), ‘ ডাকঘর’ (১৯২২), ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৬), ‘রক্তকরবী’ (১৯১৬) ‘মুক্তধারা’ (১৯২৫), এবং ‘কালের যাত্রা’ (১৯৩২) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮) নাটকে প্রাকৃতিক পটভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের মিলনের পরম সত্য। ‘রাজা’ (১৯১০) নাটকের মধ্যে জীবনের এক নিগূঢ় তত্ত্বের অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের সাঙ্কেতিক নাট্য প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হয়েছে। রাজার মধ্যে কুদর্শন রাজা ও সুন্দরী রানীর বিড়ম্বিত জীবনের কাহিনী বলা হয়েছে। এই রাজা এতই কুদর্শন যে নিজের চেহারা কারও কাছে প্রকাশ করেন না, এমন কি রানী সুদর্শনার কাছেও নয়। রানী সুন্দরের পূজারিণী। শেষ পর্যন্ত রানী সুদর্শনার সুন্দরের আকর্ষণ কিরূপে রাজার মধ্যেই চরিতার্থ হল, আলোচ্য নাটকে তাই দেখানো হয়েছে।
এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের মধ্যে এই তত্ত্বই ব্যক্ত করেছেন, ভগবানকে বাইরের রূপের মধ্যে সংশয়ের মধ্যে পাওয়া যায় না, বা ধরা যায় না, চোখের জলের মধ্যে তার সত্যরূপের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ঠাকুর্দা, সুরঙ্গমা প্রমুখ এই নাটকের বিশিষ্ট চরিত্র। ‘অচলায়তন’ (১৯২২) নাটকে প্রথা ও সংস্কারের চাপে মানবাত্মার স্বাধীন প্রকাশের বিলোপ এবং তা থেকে মুক্তিলাভের কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে বলেছেন যে আনুষ্ঠানিক আচার বিচার জপতপ মন্ত্রতন্ত্র অচল অবরোধের সৃষ্টি করে, তখনই গুরু এসে অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙ্গে মানবাত্মার মুক্তি ঘোষণা করেন। ‘ডাকঘর’ (১৯১২) নাটকে রবীন্দ্রনাথ এই তত্ত্ব প্রচার করেছেন যে অসীমের পিয়াসী মানুষের সুদূরের আকাঙ্ক্ষাকে সংস্কারের গণ্ডীবদ্ধ মানুষ ব্যাধি মনে করে নানা বাধানিষেধ তার উপর চাপিয়ে দেয়, কিন্তু মানুষ সব বাধা কাটিয়ে ভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়। সীমার সঙ্গে অসীমের মিলন ব্যক্ত হয়েছে অমলের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক স্থাপিত হবার মাধ্যমে।
‘রক্তকরবী’ (১৯১৬) রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ প্রতীক নাটক। “এতে বর্তমান কারখানা ঘরের মধ্যে রুদ্ধশ্বাস মানবজীবন এবং লোভের ফলে মানুষের মরণ ফাঁদের নিদারুণ স্বরূপ অদ্ভুত প্রতীক ও রহস্যময় ব্যঞ্জনার দ্বারা আভাসে ব্যক্ত হয়েছে।” জালের আড়ালে থাকেন অমিত শক্তিমান ও ঐশ্বর্যশালী যক্ষরাজ। তার নির্দেশে অনুচররা ধনের পাহাড় তৈরি করেছে।
শেষ পর্যন্ত মুক্তির প্রতীক নন্দিনী রাজাকে জালের আড়াল থেকে বের করে এনে প্রেমের মহিমা প্রকাশ করল। ‘মুক্তধারা’ (১৯২৫) নাটকে দেখানো হয়েছে“ সাম্রাজ্যলোভের সঙ্গে যন্ত্রবিজ্ঞানের অশুভ মিলনের ফলে মানব নির্যাতন কতদূর প্রচণ্ড ও বর্বর হতে পারে এবং সেই নির্যাতনের কোন্ রজ্রপথ দিয়ে মুক্তির বাণী আসে। “অভিজিৎ, যন্ত্ররাজ, বিভূতি প্রমুখ এই নাটকের বিশিষ্ট চরিত্র। ‘কালের যাত্রা’ (১৯৩২) নাটকে দেখানো হয়েছে সমাজের সাধারণ মানুষকে যখন ঘৃণাভরে সরিয়ে রাখা হয়, তখন মহাকালের যাত্রা থেমে পড়ে।