ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা | Powers and Rank of the President

■ প্রশ্ন:- ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো। (Powers and Rank of the President)

উত্তর:- সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে প্রভূত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। শাসন-বিভাগীয় প্রধান ছাড়া রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন ক্ষমতা ভোগ করেন। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির হাতে যে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত আছে, সেগুলিকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায় : (১) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা, (২) আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা, (৩) অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা; (৪) বিচার-বিষয়ক ক্ষমতা এবং (৫) জরুরী অবস্থা-সংক্রান্ত ক্ষমতা।

ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা | Powers and Rank of the President

(১) শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা (Executive Powers):

শাসন-বিভাগীয় প্রধান: ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতিই হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান। ভারত সরকারের শাসন বিষয়ক সকল ক্ষমতা তাঁর হাতেই ন্যস্ত আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন-সংক্রান্ত সকল কাজ রাষ্ট্রপতির নামেই সম্পাদিত হয়। তিনি নিজে বা অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন (৫৩ ধারা)।

নিয়োগ সংক্রান্ত ও অপসারণের ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতির নিয়োগ-সংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতা আছে। প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে তিনি নিযুক্ত করেন। তিনি তাঁদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করে দেন। তা ছাড়া ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারিগণও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। এটর্নি জেনারেল, অডিটর জেনারেল, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যগণ, রাজ্যের রাজ্যপালগণ, সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগণ, নির্বাচন কমিশনার প্রভৃতিকে তিনি নিযুক্ত করেন। তিনি এঁদের পদচ্যুতও করতে পারেন। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি, অডিটর জেনারেল প্রভৃতি ব্যক্তিদের অপসারণের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের সুপারিশ দরকার হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি অর্থ কমিশন, নির্বাচন কমিশন, আন্তঃরাজ্য কমিশন, ভাষা কমিশন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কতকগুলি কমিশন গঠন করেন।

সামরিক ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি হলেন সমগ্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি স্থল, নৌ ও বিমান — এই তিন বাহিনীর প্রধানদের নিযুক্ত করেন। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা বা শাস্তি স্থাপন করতে পারেন। কিন্তু পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রপতির এই সমস্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না।

● কূটনৈতিক ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্রসংক্রান্ত ক্ষমতাও আছে। বৈদেশিক ক্ষেত্রে সকল কাজকর্ম রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তিনি বিদেশে ভারতীয় কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের পাঠান। আবার অন্যান্য দেশ থেকে আগত কূটনৈতিক দূতগণকে তিনি গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সমস্ত আন্তর্জাতিক সন্ধি ও বৃক্তি রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়। কিন্তু পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া সেগুলি কার্যকর হয় না।

তত্ত্বাবধায়ক ক্ষমতা: ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি রাষ্ট্রপতির দ্বারা শাসিত হয়। তিনি নিজে প্রত্যক্ষভাবে বা মনোনীত শাসকের মাধ্যমে এই সমস্ত অঞ্চল শাসন করেন। তা ছাড়া অঙ্গরাজ্যের শাসন-বিভাগগুলিকেও তিনি প্রয়োজনমত প্রশাসনিক নির্দেশ দিতে পারেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয় ও সহযোগিতার স্বার্থে রাষ্ট্রপতি একটি আন্তঃরাজ্য পরিষদ (Inter-State Council) গঠন করতে পারেন। আবার উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা ও দায়িত্ব আছে।

■ (২) আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা (Legislative Powers):

সংসদের অধিবেশন সম্পর্কিত ক্ষমতা: ভারতের রাষ্ট্রপতির ব্যাপক আইনসংক্রান্ত ক্ষমতা আছে। ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রানীর মত ভারতের রাষ্ট্রপতিও কেন্দ্রীয় আইনসভা পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাষ্ট্রপতি এবং দুটি পরিষদ নিয়ে ভারতের পার্লামেন্ট গঠিত (৭৯ ধারা)। রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে কিংবা যে-কোন কক্ষের অধিবেশন স্থগিত রাখতে এবং প্রয়োজনবোধে লোকসভা ভেঙ্গে দিতে পারেন।

ভাষণ দান ও বাণী প্রেরণ: প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচনের পর পার্লামেন্টর প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি উদ্বোধনী ভাষণ দেন। এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহ বর্ণনা করেন। পার্লামেন্টের অন্যান্য অধিবেশনেও তিনি ভাষণ দিতে পারেন। তা ছাড়া কোনও বিল বা অন্য কোন বিষয়ে তিনি পার্লামেন্টে বাণী প্রেরণ করতে পারেন। আবার কোন বিষয়ে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হলে তিনি কক্ষদ্বয়ের যুগ্ম অধিবেশন আহ্বান করে তা নিরসনের ব্যবস্থা করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১২ জন সদস্যকে মনোনীত করতে পারেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সমাজসেবা প্রভৃতি বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে তিনি এই কল সদস্য মনোনীত করেন। তা ছাড়া ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত অনধিক ২ জন ব্যক্তিকে তিনি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মনোনীত করতে পারেন।

বিলে সম্মতি প্রদান: পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পাস হওয়ার পর প্রত্যেকটি বিলকে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য পাঠাতে হয়। রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিতে পারেন, নাও দিতে পারেন। আবার অর্থ বিল ছাড়া অন্য বিল হলে তিনি তা পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টে ফেরত পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিলটি পার্লামেন্ট কর্তৃক দ্বিতীয়বার গৃহীত হলে তাতে তিনি স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন (১১১ ধারা)। কিন্তু অর্থবিল পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠান যায় না। সংবিধান সংশোধনী বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিতে বাধ্য।

রাজ্য আইনসভার বিল: রাজ্যের আইনসভায় পাস হওয়ার পর যে-কোন বিল সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপালের কাছে যায়। রাজ্যপাল নিজে অনুমোদন না করে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য বিলটি পাঠিয়ে দিতে পারেন (২০১ ধারা)। সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হাইকোর্টের ক্ষমতা সম্পর্কিত বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান রাজ্যপালের পক্ষে বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলে তবেই তা আইনে পরিণত হতে পারে। রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিতে পারেন, নাও দিতে পারেন, আবার পুনর্বিবেচনার জন্য ঐ রাজ্যের আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু সেখানে তা দ্বিতীয়বার গৃহীত হওয়ার পরও রাষ্ট্রপতি সম্মতি না জানাতে পারেন।

জরুরী আইন জারী: পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতি বিশেষ প্রয়োজনে পার্লামেন্টের এক্তিয়ারভুক্ত যে কোন বিষয়ে জরুরী আইন জারি করতে পারেন। তা আইনের মতই কার্যকর হয়। পুনরায় পার্লামেন্টের অধিবেশন বসলে জরুরী আইনটিকে সাধারণ আইনে পরিণত করার জন্য উভয় কক্ষের সম্মুখে পেশ করতে হয়। পুনরায় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত তা কার্যকর থাকতে পারে। তবে তার আগেই রাষ্ট্রপতি তা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। আবার পার্লামেন্টও ইচ্ছা করলে তা বাতিল করে দিতে পারে। কতকগুলি বিল আছে যা রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ছাড়া পার্লামেন্টে পেশ করা যায় না। উদাহরণ হিসাবে অর্থবিল, অঙ্গরাজ্যের নাম ও সীমানা পরিবর্তন সম্পর্কিত বিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া বাজেট, অর্থকমিশনের সুপারিশ প্রভৃতি রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে পার্লামেন্টে পেশ করতে হয়।

(৩) অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা (Financial Powers): সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক আর্থিক বছরের জন্য রাষ্ট্রপতিকে আনুমানিক আয়-ব্যয়ের একটি বিবরণী বা বাজেট পার্লামেন্টে পেশ করতে হয়। সাধারণতঃ কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট পার্লামেন্টে পেশ করেন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কোন ব্যয় মঞ্জুরীর দাবি পার্লামেন্টে উত্থাপন করা যায় না। আকস্মিক ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য ভারতের একটি আকস্মিকতা তহবিল (Contingency Fund of India) আছে। এই তহবিল রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকে।

পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে আকস্মিক ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি এই তহবিল থেকে অগ্রিম অর্থ মঞ্জুর করতে পারেন। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে আদায়িকৃত রাজস্ব বণ্টনের জন্য প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর তিনি একটি অর্থ কমিশন (Finance Commission) গঠন করেন। তিনি কমিশনের সুপারিশসমূহ পার্লামেন্টে পেশ করেন।

(৪) বিচার-বিষয়ক ক্ষমতা (Judicial Powers): রাষ্ট্রপতির কিছু বিচার-বিভাগীয় ক্ষমতাও আছে। তিনি সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিযুক্ত করেন। পার্লামেন্টের সুপারিশক্রমে তিনি তাঁদের পদচ্যুতও করতে পারেন। ফৌজদারী মামলায় দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ রাষ্ট্রপতি স্থগিত রাখতে পারেন, হ্রাস করতে পারেন, আবার দণ্ডিত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন। তা ছাড়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড রদ করে তিনি অন্য দণ্ড দিতে পারেন।

(৫) জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা (Emergency Powers): উল্লিখিত ক্ষমতাগুলি ছড়াও জরুরী অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে কতকগুলি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জরুরী অবস্থাকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এগুলি হল: (ক) জরুরী বা আপৎকালীন অবস্থা ঘোষণা, (খ) অঙ্গরাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণা এবং (গ) আর্থিক সঙ্কটাবস্থা ঘোষণা। ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির প্রকৃত ভূমিকা ও পদমর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। তাই এ বিষয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে নেহরু ও রাজেন্দ্রপ্রসাদের আমল থেকেই। গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে বলা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রানীর মত নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধানের ভূমিকা গ্রহণ করবেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতানুসারে এদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রিসভা ও আইনসভার হাতে ন্যস্ত — রাষ্ট্রপতির হাতে নয়।

অপরদিকে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিI রাজেন্দ্রপ্রসাদ রাষ্ট্রপতিকে নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসাবে মেনে নিতে রাজি হন। রাষ্ট্রপতির প্রকৃত পদমর্যাদা এবং মন্ত্রিসভার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রসঙ্গে গভীর মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। এক শ্রেণীর সংবিধান বিশেষজ্ঞ তত্ত্বগতভাবে বলেন যে, রাষ্ট্রপতিই হলেন দেশের প্রকৃত শাসক। এঁরা হলেন তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী (Legal School)। অপরপক্ষে বাস্তববাদী সংবিধান বিশেষজ্ঞদের (Political School) মতানুসারে তিনি হলেন একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান মাত্র। রাষ্ট্রপতির ব্যাপক ক্ষমতার পরিধি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী বিশেষজ্ঞরা সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন। এঁদের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাষ্ট্রপতিই হলেন ভারতের প্রকৃত শাসকপ্রধান। তিনি ইচ্ছা করলে সকল ক্ষমতা নিজে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। ব্রিটেনের রাজা বা রানীর পদমর্যাদার সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদার তুলনা চলে না । রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা সম্পর্কে বাস্তববাদী সংবিধান-বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন মত পোষণ করেন। এঁদের মতানুসারে রাষ্ট্রপতি নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান। ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রানীর মত তাঁর ভূমিকা আনুষ্ঠানিক মাত্র।

ডঃ আম্বেদকর বলেছেন: “ ইংল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রানী যে পদমর্যাদা ভোগ করেন, ভারতের রাষ্ট্রপতিও সমমর্যাদাসম্পন্ন বাস্তববাদী সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের মতে সংবিধানের সংকীর্ণ তত্ত্বগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এর প্রকৃত স্বরূপটি বোঝা যায় না। সংবিধানের বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুনের সঙ্গে প্রচলিত প্রথাপ্রকরণ ও রীতিনীতিকে যুক্ত করে বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। তা হলে শাসনব্যবস্থার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাবে। তবে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ছাড়া অন্য কোন রাষ্ট্রপতি তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলেন নি। সকলেই সাংবিধানিক প্রধানের ভূমিকা পালন করেছেন।

বর্তমানে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শের দ্বারা আবদ্ধ। তিনি আনুষ্ঠানিক প্রধান মাত্র। তবে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা বা অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে, বা অবস্থাভেদে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ বা লোকসভা ভেঙে দেওয়ার মতো দু’একটি ক্ষেত্রে সুবিবেচনা প্রয়োগের সুযোগ এখনও রাষ্ট্রপতির আছে। ভারতের মত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রপ্রধানকে পুরোপুরি অপরের পরামর্শমতো চলতে বাধ্য করা উচিত নয়। এবং তা সম্ভবও নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মোকাবিলা এবং সাংবিধানিক কাঠামো বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের সুযোগ থাকা দরকার। সর্বোপরি মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার সম্বলিত শপথ নিতে হয়। মন্ত্রিসভার পরামর্শ মানলে যদি এই শপথ লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তাহলে রাষ্ট্রপতির সেই পরামর্শ মানা নিশ্চয়ই সঙ্গত হবে না।