■ প্রশ্ন:- ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো (Powers and Functions of the Governor)।
উত্তর:- সংবিধান অনুযায়ী অঙ্গরাজ্যের শাসন – বিভাগীয় সকল ক্ষমতা রাজ্যপালের হাতে ন্যস্ত আছে। রাজ্যের শাসনকার্য তাঁর নামে পরিচালিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্যপালের ব্যাপক ক্ষমতা বর্তমান। রাজ্যপালের ক্ষমতাগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়; (ক) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা, (খ) আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা, (গ) অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা, (ঘ) বিচার-সংক্রান্ত ক্ষমতা এবং (ঙ) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা।
ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যাবলী | Powers and Functions of the Governor
■ (ক) শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা:-
● শাসন-বিভাগীয় প্রধান: রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের শাসন-বিভাগীয় প্রধান। সংবিধান অনুসারে রাজ্যের শাসন সম্পর্কিত সকল ক্ষমতা রাজ্যপালের উপর ন্যস্ত থাকে। তিনি নিজে বা অধীনস্থ কর্মচারীদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।(১৫৪ ধারা)। তবে রাজ্যপালকে সংবিধান অনুসারে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্ম তাঁর নামেই সম্পাদিত হয়। রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য রাজ্যপালকে প্রয়োজনীয় নিয়ম পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হয়। রাজ্যের তালিকাভুক্ত সকল বিষয়েই তাঁর শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রযোজ্য। যুগ্মতালিকাভুক্ত বিষয়ে রাজ্যসরকারের আইনগুলির উপরও তাঁর শাসন – সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রযুক্ত হতে থাকে। তবে এ সমস্ত বিষয়ে কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতাই প্রাধান্য পায়।
● শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে অবহিত হওয়া: মন্ত্রিসভার সকল সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ সম্পর্কে রাজ্যপালকে অবহিত করতে হয়। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ দায়িত্ব আছে। রাজ্যপালের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণা করেন।
● নিয়োগ-সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাজ্যপালের ব্যাপক নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা আছে। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিযুক্ত করেন। তবে বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করতে হয়। তা ছাড়া তিনি রাজ্যের এ্যাডভোকেট জেনারেল (Advocate General), রাজ্যের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (State Public Service Commission) সদস্যদের এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিযুক্ত করেন। রাজ্যপাল মন্ত্রীদের পদচ্যুত করতে পারেন। রাজ্যের হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি অপরিহার্যভাবে রাজ্যপালের সঙ্গে পরামর্শ করেন (২১৭ ধারা)।
● তফসিলী জাতি ও উপজাতিদের জন্য দায়িত্ব: রাজ্যপাল হলেন সকল রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। তিনি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যদের নিযুক্ত করেন। রাজ্যের তফসিলী উপজাতি, তপসিলী বর্ণ এবং অনুন্নত শ্রেণীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতির ক্ষেত্রে রাজ্যপালের উপর বিশেষ দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। এই উদ্দেশ্যে রাজ্যপালকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রতিবছর প্রতিবেদন পাঠাতে হয়।
■ (খ) আইন-সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি যেমন সংসদের, রাজ্যপালও তেমনি রাজ্যের আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাজ্যপাল এবং একটি বা দু’টি কক্ষ নিয়ে রাজ্যের আইনসভা গঠিত হয়। রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে এবং স্থগিত রাখতে পারেন। আবার প্রয়োজনবোধে তিনি নির্দিষ্ট কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে বিধানসভাকে ভেঙ্গে দিতে পারেন।
● সদস্য মনোনয়ন: রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভায় ভাষণ দিতে পারেন অথবা বাণী প্রেরণ করতে পারেন। রাজ্যের আইনসভা দু’টি কক্ষ নিয়ে গঠিত হ’লে রাজ্যপাল উচ্চকক্ষে বা বিধান পরিষদে (Legislative Council) সাহিত্য, ললিতকলা, বিজ্ঞান, সমাজসেবা, সমবায় আন্দোলন প্রভৃতি বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কয়েকজন সদস্যকে মনোনীত করতে পারেন। তা ছাড়া নিম্ন কক্ষ বা বিধানসভায় (Legislative Assembly) ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের উপযুক্ত সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচিত না হয়ে থাকলে রাজ্যপাল একজন ঐ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মনোনীত করেন।
● বিলে সম্মতি জ্ঞাপন: রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। রাজ্য আইনসভায় পাস হওয়ার পর প্রত্যেক বিলকে রাজ্যপালের কাছে তাঁর সম্মতির জন্য পাঠাতে হয়। রাজ্যপালের কাছে বিল এলে তিনি বিলে সম্মতি দিতে পারেন; সম্মতি নাও দিতে পারেন; আবার রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য বিলটিকে তাঁর কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন। তা ছাড়া অর্থ বিল ছাড়া অন্যান্য বিলকে তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য রাজ্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। তবে আইনসভা বিলটি দ্বিতীয়বার একইভাবে গ্রহণ করলে রাজ্যপাল তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করতে বাধ্য থাকেন।
● জরুরী আইন জারি: রাষ্ট্রপতির মত রাজ্যপালও জরুরী আইন বা অর্ডিন্যান্স (ordi nance) জারি করতে পারেন। রাজ্য আইনসভার অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে রাজ্যপাল জরুরী আইন জারি করে থাকেন। আইনসভার পরবর্তী অধিবেশন শুরু হবার পর ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট আইন বলবৎ থাকতে পারে। তবে তার আগেই যদি আইনসভা জরুরী আইনটি গ্রহণ করে, তাহলে তা আর বাতিল হয় না।
■ (গ) অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা: প্রত্যেক আর্থিক বছর সম্পর্কে রাজ্যপালের বিশেষ দায়িত্ব আছে। প্রত্যেক আর্থিক বছরের জন্য রাজ্যসরকারের আনুমানিক আয়-ব্যয়ের একটি বিবরণী (Annual Financial Statement) বা বাজেট (Annual Budget) বিধানসভায় পেশ করতে হয় ( ২০২ ধারা)। সাধারণতঃ রাজ্যপালের পক্ষে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীই এই দায়িত্ব সম্পাদন করেন। রাজ্যপালের সুপারিশ ছাড়া কোন ব্যয়-বরাদ্দের দাবি উত্থাপন করা যায় না। এবং তার অনুমতি ছাড়া কোন অর্থ বিল বিধানসভায় পেশ করা যায় না (২০৫ ও ২০৭ ধারা)। রাজ্যপালের তত্ত্বাবধানে রাজ্যের জরুরী তহবিল (Contingency Fund) থাকে। আকস্মিক কোন ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজ্য আইনসভার অনুমোদন সাপেক্ষে তিনি এই তহবিল থেকে ঋগ্রিম অর্থ মঞ্জুর করতে পারেন।
■ (ঘ) বিচার-সংক্রান্ত ক্ষমতা:- রাজ্যের হাইকোর্ট ছাড়া অন্যান্য অধস্তন সকল আদালতের বিচারপতিদের রাজ্যপাল নিযুক্ত করেন। এঁদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে তিনি উচ্চ আদালতের সঙ্গে পরামর্শ করেন। রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়ে আইন অমান্যজনিত অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তিকে রাজ্যপাল ক্ষমা করতে পারেন কিংবা দণ্ডাদেশ লাঘব করতে পারেন। তা ছাড়া তিনি দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখতে পারেন বা একপ্রকার দণ্ডের পরিবর্তে অন্যপ্রকার দণ্ডের ব্যবস্থা করতে পারেন (১৬১ ধারা)। তবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখতে পারলেও ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনন্য ক্ষমতা আছে।
■ (ঙ) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা: উপরিউক্ত ক্ষমতাগুলি প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক শাসক প্রধান হিসাবে রাজ্যপাল রাজ্যের মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে চলেন। কিন্তু রাজ্যপালের কিছু স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাও আছে। সংবিধানের ১৬৩ ধারায় স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা আছে। তিনি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য নন। সংবিধান অনুসারে নিম্নলিখিত কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা আছে।
● (১) অসমের স্ব-শাসিত উপজাতি অঞ্চলে খনিজসমূহের উপস্বত্ব বা ‘রয়্যালটি’ সম্পে জেলা পরিষদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কোন বিরোধ বাধলে, তার মীমাংসার ক্ষেত্রে অসমের রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা আছে।
● (২) রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসাবে অসমের উপজাতি এলাকার শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে অসমের রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা আছে।
● (৩) রাষ্ট্রপতি যদি কোন রাজ্যের রাজ্যপালকে পার্শ্ববর্তী কোন কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন, তাহলে তিনি ঐ অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন [২৩৯ (২) ধারা]।
● (৪) গুজরাট ও মহারাষ্ট্র রাজ্য দু’টির কোন অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্য দু’টির রাজ্যপালকে বিশেষ দায়িত্ব দিতে পারেন [৩৭১ (২) ধারা]। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
● (৫) নাগাল্যাণ্ডে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ যতদিন থাকবে, ততদিন ঐ রাজ্যের রাজ্যপালের আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে বিশেষ ক্ষমতা থাকবে [৩৭১ (ক) ধারা।]। নাগাল্যাণ্ডের তিয়েনসান জেলার আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের ব্যাপারে রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
● (৬) সিকিমের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সিকিমের রাজ্যপাল কিছু বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করেন [৩৭১ (চ) ধারা]।
● (৭) মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য ঐ সমস্ত পার্বত্য অঞ্চল থেকে নির্বাচিত বিধানসভা-সদস্যদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি একটি কমিটি গঠন করতে পারেন। এই কমিটির কাজকর্ম তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালের উপর ন্যস্ত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও রাজ্যপাল স্ববিবেচনামত কাজ করেন [৩৭১ (গ) ধারা]। তা ছাড়া
● (৮) রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য কোন রাজ্যবিল আটকে রাখা; এবং
● (৯) রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতিকে প্রদান — এ দুটি ক্ষেত্রেও রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করেন।
রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার পরিধি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় নি। কোন একটি বিষয় রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত কিনা এ বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে রাজ্যপালের সিদ্ধান্তই হল চূড়ান্ত [১৬৩ (২) ধারা]। সংবিধানের এই ধারা অনুসারে কোন বিষয়ে তাঁকে স্বেচ্ছাধীন = ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে কিনা সে বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং কোন বিষয়ে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করা উচিত ছিল কিনা তার ভিত্তিতে তাঁর কোন কাজের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না।