Philosophy : Western philosophy is called ‘Philosophy in India’. But the nature of philosophy and philosophy is not one. Philosophy ‘is an English word. The word comes from two Greek words. One is “Philos”. It means affection. The other is “Sophia”. It means knowledge. So the word Philosophy literally means knowledge.
দর্শন বিদ্যা (Philosophy):
পাশ্চাত্য দেশের ‘Philosophy’ -কে ভারতবর্ষে ‘দর্শন’ বলা হয়। কিন্তু Philosophy এবং দর্শন দুটির প্রকৃতি এক নয়। ‘Philosophy’ হল একটি ইংরেজি শব্দ। এই শব্দ দুটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। একটি হল “Philos”. এর অর্থ হল অনুরাগ। অন্যটি হল “Sophia”. এর অর্থ হল জ্ঞান কাজেই Philosophy শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল জ্ঞান অনুরাগ বা জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ। ‘দর্শন’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘দেখা’ বা ‘প্রত্যক্ষ করা’ কিন্তু সব দেখাই কি ‘দর্শন’ ? না। দর্শন হল সত্যকে সমগ্রভাবে দেখার চেষ্টা। এখানে ‘দেখা’ বলতে চোখের দেখা নয়, ‘উপলদ্ধি’-কে বুঝতে হবে।
কিন্তু তবুও Philosophy- কে দর্শন বললে অসুবিধা হয় না। কারণ-
(ক) পাশ্চাত্য দেশে Philosophy হল জ্ঞান – অনুরাগ। আমাদের দেশে দর্শন হল সত্য বা তত্ত্ব-উপলদ্ধি। জ্ঞান ও সত্য-দুটির মধ্যে পার্থক্য টানা যায় না। জ্ঞান হল পথ, সত্য বা তত্ত্ব হল লক্ষ্য। এবং জ্ঞান মাত্রই সত্য-মুখী। তাই পাশ্চাত্যের জ্ঞান-অনুরাগকে সত্য-অনুরাগ বললে ক্ষতি কী ? জ্ঞানের আলােচনায় সত্য বা তত্ত্বের কথা তাে আসবেই।
(খ)সত্যকে জানতে হলে জ্ঞানের পথেই জানতে হবে। জ্ঞানের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য বিচারই একমাত্র সম্বল। তাই জ্ঞান ও সত্য-দুটির ক্ষেত্রেই আলােচনার ভিত্তি হল যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য বিচার-বিশ্লেষণ।
(গ) Philosophy জগৎ ও জীবনের পরিচিতি পরিধি থেকেই জ্ঞান- অনুসন্ধান শুরু করে। দর্শনও সত্য উপলব্ধিতে জগৎ ও জীবনকে অস্বীকার করে না। কাজেই Philoso phy এবং দর্শন-দুটির আলােচনাই জগৎ ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত।
মানুষ জানতে চায়। অর্থাৎ, সে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী। তাই সে দার্শনিক। কখনও নিজের সম্বন্ধে, কখনও জগৎ ও জীবনের সম্বন্ধে, কখনও বা এই সবের উর্ধ্বে থাকা পরতুত্ত্বের সম্বন্ধে নানা জিজ্ঞাসা তার মনে জাগে। এগুলি অবশ্যই দার্শনিক জিজ্ঞাসা। এই অন্তহীন চলমান জিজ্ঞাসার কোনাে স্থির, নির্দিষ্ট এবং সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই। তাই দর্শনের সংজ্ঞা নেই, থাকা সম্ভবও নয়। তবুও ‘দর্শন’ (Philosophy) কী ?-এই প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন ভাবে তাদের বক্তব্য রেখেছেন। এইসব বক্তব্যের ভিত্তিতে দর্শনের সংজ্ঞা নিম্নরূপভাবে দেওয়া যেতে পারে।
দর্শনের সংজ্ঞ (Definition of philosophy):
যেশাস্ত্রে অতীন্দ্রিয় ‘এক’ বা পরমতত্ত্ব সম্পর্কে এবং ‘বহু’ বা জগৎ ও জীবনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদানের চেষ্টা আছে, যে-শাস্ত্রে ‘বহু’- কে ‘এক’ বা অখণ্ডের খণ্ড বা সীমিত প্রকাশ হিসাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা আছে, যে – শাস্ত্রে ‘এক’-এর মূল্য বা আদর্শকে সামনে রেখে ‘বহু’-র মূল্য বিচারের চেষ্টা আছে। সেই শাস্ত্রকে দর্শনশাস্ত্র বা দর্শন বলে।
দর্শনের এই সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে পাঁচটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে-
(i) পরমতত্ত্ব অতীন্দ্রিয় ‘এক’ বা অখণ্ডের ধারণা।
(ii) জগৎ ও জীবন-বৈচিত্র্য। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ‘বহু’ বা খণ্ডের ধারণা।
(iii) সম্বন্ধ || পরমতত্তের সঙ্গে জগৎ ও জীবনের সম্বন্ধের ধারণা।
(iv) জ্ঞান ৷৷ যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য বিচার-বিশ্লেষণের ধারণা।
(v) মূল্য ।। সত্য, শিব ও সুন্দর এই তিনটি মুল্য বা আদর্শের ধারণা। চিত্তার আদর্শ হল সত্য, ইচ্ছাকৃত কর্মের আদর্শ হল শিব বা কল্যাণ এবং অনুভূতির আদর্শ হল সুন্দর।
দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি(The nature of philosophy):
সংজ্ঞা জানা থাকলে তবেই কোনাে শাস্ত্রের স্বরুপ নির্ণয় করা যায়। দর্শনের কোনাে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তাই দর্শনের স্বরুপও নির্দিষ্ট নয়। এই বাস্তব অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখেও দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি হিসাবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উল্লেখ করা যেতে পারে।
(১)দর্শনের সমস্যা(Philosophy problems):
দর্শনের স্বরূপগত সমস্যাই দর্শনের স্বরুপ নির্দেশ করেছে কোনাে শাস্ত্রের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট থাকলে তবেই তার স্বরূপ নির্ণয় করা যায়। বিজ্ঞান কী ? বিজ্ঞান কেমন ?- এই সব প্রশ্নের নির্দিষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর আছে। তাই এই সব প্রশ্ন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনাে সমস্যা সৃষ্টি করেনি। কিন্তু দর্শন কী ? দর্শন কেমন ? দর্শন বলে কোনাে শাস্ত্র সত্যই কী সম্ভব ?-এই সব প্রশ্ন দর্শনের মধ্যেই উঠেছে এবং এর উত্তরে দার্শনিকেরা একমত হতে পারেননি। ফলে, এই সব প্রশ্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এই সমস্যাই হল দর্শনের স্বরূপগত সমস্যা। এই সমস্যাই দর্শনের স্বরূপকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে এবং দর্শনকে নিজস্ব একটা স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
(২) দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি(Philosophical perspectives):
দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি হল সামগ্রিক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হল সেই দৃষ্টিভঙ্গি যার সাহায্যে। আমাদের খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা গুলি সমগ্রের অংশ হিসাবে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে৷ বিরাট বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে তিন ধরনের বিষয় আমাদের চোখে পড়ে। এগুলি হল — জড়, প্রাণ এবং চৈতন্য। সাধারণ দৃষ্টিতে এদের স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন বলেই মনে হয়। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি এই স্বাতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্নতাকে মেনে নিতে চায় না। মানুষ এগুলিকে একটি ঐক্যসূত্রে বেঁধে ফেলতে চায় এবং অর্থপূর্ণ করে তুলতে চায়। দর্শন মানুষের এই বুদ্ধির দাবি মেটাবার চেষ্টা করে। দর্শন তার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতাগুলিকে সমন্বিত করে এবং সমগ্রের পটভূমিকায় রেখে এদের সার্বিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে। তাই দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমগ্ৰতাবােধ, সমন্বয়ধর্মিতা এবং সার্বিকতা একই সঙ্গে কাজ করে।
জগতের বিভিন্ন বস্তু এবং বিষয় নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ আলােচনার জন্য নানা শাস্ত্র আছে। দর্শন তার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে এই সব শাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে চায় এবং এদের মর্ম উপলদ্ধি করতে চায়। এর ফলে, বিভিন্ন শাস্ত্র নিজেদের বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝে নিতে পারে। এইজন্য দর্শনকে সর্ববিদ্যা – প্রতিষ্ঠা এবং সর্বব্যাপক শাস্ত্র বলা হয়।
(৩) দর্শনের পদ্ধতি (Method of philosophy):
দর্শনের পদ্ধতি হল বিচারমূলক পদ্ধতি বিচারমূলক পদ্ধতি হল সেই পদ্ধতি যার মাধ্যমে। আলােচ্য বিষয়ের যুক্তিগ্রাহ্য, বুদ্ধিগ্রাহ্য সার্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়।
বিজ্ঞান ও অন্যান্য শাস্ত্রে আলােচ্য বিষয়ের খুঁটিনাটি জানতে চাওয়া হয়। এখানে বিশ্লেষণই বড়াে কথা। এর জন্য এই সব ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণকে পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। দর্শনের লক্ষ্য আলাদা। এখানে বস্তু বা বিষয়ের খুঁটিনাটি বা বিশ্লেষণ বড়াে কথা নয়, বড়াে কথা হল স্বরূপ উপলদ্ধি এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যা। এই কাজে যুক্তিগ্রাহ্য, বুদ্ধিগ্রাহ্য বিচারই হল একমাত্র পদ্ধতি। যা বিচারগ্রাহ্য, তাই গ্রহণযােগ্য। বিচারই দর্শনের প্রাণ। দর্শনের ভাষা। হল বিচারের ভাষা। দর্শনের পদ্ধতি হল বিচারের পদ্ধতি। দর্শনে কল্পনা এসে যেতে পারে। কিন্তু সেই কল্পনাকে অবশ্যই বিচারসম্মত হতে হবে।
(৪) দর্শনের কাজ (The work of philosophy):
দর্শনের লক্ষ্য হল বস্তু বা বিষয়ের স্বরূপ সন্ধান। এই লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য দর্শনকে তিন ধরনের কাজ করতে হয়-
(ক) ব্যাখ্যা দান : দর্শনের কাজ হল বিষয়বস্তুর সার্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া। সার্বিক ব্যাখ্যা বলতে বােঝায়-বিষয়বস্তুকে আলাদাভাবে না-দেখে সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা। এইভাবে ব্যাখ্যা একমাত্র বুদ্ধির পক্ষেই সম্ভব। কারণ, বিষয়বস্তুকে বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে, তাকে সমগ্রের সঙ্গে সমন্বিত করে তবেই সার্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। এবং দর্শন এইভাবেই বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা দেয়।
(খ) যাথার্থ্য নির্ণয় : বিজ্ঞান এবং অন্যান্য শাস্ত্র কতকগুলি মৌলিক সত্যকে বিনা বিচারে মেনে নিয়ে তাদের কাজ শুরু করে। এগুলিকে অবশ্যস্বীকার্য সত্য বলা হয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কার্য-কারণ,দেশ কাল প্রভৃতি হল অবশ্যস্বীকার্য সত্য। তেমনি নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা হল। অবশ্যস্বীকার্য সত্য। দর্শন এই সব মৌলিক স্বীকৃত সত্যগুলির প্রকৃতি জানতে চায়। দেশ কাল, কার্য-কারণ ইত্যাদি বিষয়কে বিচার – বিশ্লেষণ করা এবং তাদের যথার্থ নির্ণয় করা দর্শনের অন্যতম কাজ। আর, এইজন্যই দর্শনকে বিজ্ঞান এবং অন্যান্য শাস্ত্রের ভিত্তি বলা হয়।
(গ) মূল্য-বিচার : সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া দর্শনের কাজ। সঠিক ব্যাখ্যার অন্যতম অঙ্গ হল মূল্য-বিচার। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার মূল্য-বিচার করতে গেলে তাকে কোনাে-না-কোনাে আদর্শের সঙ্গে তুলনা করি। চিন্তা, ইচ্ছা ও অনুভূতি এই তিনটি হল আমাদের অভিজ্ঞতার অঙ্গ। আমাদের চিন্তার সামনে থাকে সত্যতার আদর্শ। অর্থাৎ, আমরা চাই আমাদের চিন্তা বা অনুমান সত্য হােক।
আমাদের ইচ্ছা এবং আচরণের সামনে থাকে, শিব, কল্যাণ বা সততার আদর্শ। অর্থাৎ, আমরা চাই আমাদের আচরণ ভালাে হােক। আমাদের অনুভূতির সামনে থাকে সুন্দরের আদর্শ। অর্থাৎ, আমরা চাই আমাদের অনুভূতি সুন্দর হােক। সত্য, শিব ও সুন্দর হল পরমমূল্য। দর্শন আমাদের চিন্তাকে সত্যতার মূল্যে, ইচ্ছাকে সততার মূল্যে এবং অনুভূতিকে সৌন্দর্যের মূল্যে মূল্যায়িত করে দেখতে চায়। এছাড়া, এই মূল্যগুলির স্বরূপ কেমন ? এরা মনােগত, বস্তুগত ? অর্থাৎ এই সব মূল্য আমাদের মন বা বুদ্ধিতে আছে ? না, বাস্তব জগতে এদের অস্তিত্ব ছে ?-এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দর্শনের কাজ।
(৫)দর্শনের বিষয় (The subject of philosophy):
জগৎ, জীবন এবং অভিজ্ঞতা হল দর্শনের আলােচ্য বিষয়। এই সব বিষয়ের আলােচনা বিজ্ঞান এবং অন্যান্য শাস্ত্রেও আছে। কিন্তু এখানে এই আলােচনা পুরােপুরি বিষয় কেন্দ্রিক। এখানে বিষয়কে নিছক বিষয় হিসাবেই দেখা হয়। আমাদের অভিজ্ঞতার বিষয় হিসাবে দেখা হয় না। অথচ, জ্ঞানের বিষয়কে জ্ঞাতার সঙ্গে জড়িয়ে না নিলে বিষয়জ্ঞান সম্পূর্ণ হতে পারে না। দর্শন বিষয়কে দেখে, সেটি যে জ্ঞাতার অভিজ্ঞতার বিষয়- এ কথা মানে এবং জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে তাকে সমগ্রের পটভূমিকায় রাখে। এইভাবে সমগ্রের অঙ্গ হিসাবে জগৎ, জীবন এবং অভিজ্ঞতা দর্শনের বিষয়বস্তু হিসাবে এসে পড়ে।
(৬) দর্শনের প্রবণতা (The tendency of philosophy):
অদ্বৈতবাদের দিকে দর্শনের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। অদ্বৈতবাদ হল সেই মতবাদ, যাতে পরমতত্ত্ব বা মূল সত্য হিসাবে একটিমাত্র বিষয়কে স্বীকার করা হয়।
জগৎ হল অনেক -এর সমষ্টি। সাধারণভাবে জগতের প্রত্যেকটি বস্তু বা বিষয়কে স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। মনে হয়, জড় একটি তত্ত্ব, প্রাণশক্তি একটি তত্ত্ব, চৈতন্য একটি তত্ত্ব। দর্শন এদের আলাদা আলাদা তত্ত্ব হিসাবে মানতে চায় না। দর্শন জগতের সমস্ত কিছুকে একটি মূল বা পরমতত্ত্বের অঙ্গীভূত করে দেখতে চায় এবং এইভাবে ‘এক’- এর আলােয় ‘অনেক’- এর ব্যাখ্যা দিতে চায়। তাই বহুত্ববাদ থেকে একতত্ত্ব বা অদ্বৈতবাদের দিকে চলে যাবার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা দর্শনে লক্ষ্য করা যায়।
(৭) দর্শনের প্রভাব (The effect of philosophy):
মানুষের জীবনে দর্শনের সর্বব্যাপী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ নিজেকে জানতে চাইছে। তার অন্তরের চিরন্তন জিজ্ঞাসাগুলি এক এক যুগের আলােয় নতুন নতুন জবাব খুঁজে ফিরছে। আমি কে ? আমি কী? আমি কেমন ? আমার উদ্দেশ্য কি ? এই সব প্রশ্ন প্রতিনিয়তই তাকে ব্যাকুল করে তুলছে। এগুলি হল দর্শনের প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের উত্তর- অনুসন্ধান দর্শন ছাড়া অন্য কোনাে শাস্ত্রে নেই। আর, এই প্রশ্নগুলির প্রভাব তার সমাজজীবন, সংসারজীবন এবং নৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই মানুষের জীবনে দর্শনের সর্বব্যাপী প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
দর্শনের বিষয়বস্তু (The content of philosophy):
দর্শনের কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই। কারণ, জগৎ ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে আলােচনা করাই দর্শনের কাজ। কাজের এই ব্যাপকতার দিকে লক্ষ্য রেখে দর্শনের আলােচ্য বিষয়বস্তুকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে-
(১) অবভাস-সংক্রান্ত আলােচনা : জগতের দৃশ্যমান রূপ বা অবভাসের অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়। দর্শন অবভাসকে অস্বীকার করে না। এই অবভাস সংক্রান্ত আলােচনায় দর্শনকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হয়। এইসব সিদ্ধান্তকে বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের সমন্বিত বা ঐক্যবদ্ধ করাই হল দর্শনের কাজ। বিজ্ঞানগুলিকে এক কথায় প্রকাশবিদ্যা বলে। দর্শনের অন্যতম শাখা হিসাবে প্রকাশবিদ্যা দর্শনের অবভাস সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আলােচনা করে।
(২) বিজ্ঞানের মূলতত্ত্বসংক্রান্ত আলােচনাঃ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত গঠনে দেশ- কাল, দ্রব্য গুণ, কার্য-কারণ প্রভৃতি কতকগুলি মৌলিক ধারণাকে বিনা বিচারে মেনে নেওয়া হয়। এগুলি হল বিজ্ঞানের স্বীকৃত সত্য। দর্শন এই সব স্বীকৃত সত্যের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে চায়। তাই ভশন হল বিজ্ঞান বা প্রকাশবিদ্যার ভিত্তি প্ৰকাশবিদ্যার মৌলিক তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনা দর্শনের বিষয়বস্তু।
(৩) অধিবিদ্যা তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনাঃ বস্তু বা বিষয়ের বাহ্যরূপ স্থান কাল ও পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু বস্তু-স্বরুপ নিত্য বা অপরিবর্তনীয়। দর্শনের মূল লক্ষ্য হল। বস্তু বা বিষয়ের স্বরুপ ব্যাখ্যা করা। দর্শনের অন্যতম শাখা হিসাবে অধিবিদ্যা বস্তুর স্বরূপ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আলােচনা করে।
(৪) জ্ঞানবিদ্যা বা জ্ঞান সংক্রান্ত আলােচনাঃ দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান তুলে ধরতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে : এই জ্ঞান কি সম্ভব ? সম্ভব হলে, এর উৎস কি ? স্বরূপ কি ? সীমা কতটুকু ? জ্ঞানের সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় কি ? দর্শনের অন্যতম শাখা হিসাবে জ্ঞানবিদ্যা এই সব প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে।
(৫) মূল্যবিদ্যা বা মূল্য-সংক্রান্ত আলােচনা : চিন্তা, ইচ্ছা ও অনুভূতি-এই তিনটির মধ্য দিয়ে আমাদের মনের প্রকাশ ঘটে। চিন্তা বা অনুমানের সামনে আদর্শ হিসাবে থাকে সত্য। ইচ্ছা এবং ইচ্ছা থেকে উৎপন্ন আচরণের সামনে আদর্শ হিসাবে থাকে শিব বা কল্যাণ। অনুভূতির সামনে আদর্শ হিসাবে থাকে সুন্দর। সত্য, শিব ও সুন্দর-এই তিনটি আদর্শকে মূল্য বলে। দর্শনের অন্যতম শাখা হিসাবে মূল্যবিদ্যা এইসব মূল্য বা আদর্শ সম্পর্কে আলােচনা করে। মূল্যবিদ্যা এই কাজ তিনটি শাখার মাধ্যমে করে-
(i) যুক্তিবিজ্ঞান চিন্তার আদর্শ হিসাবে সত্যের স্বরূপ আলােচনা করে।
(ii) নীতিবিজ্ঞান ইচ্ছা ও আচরণের আদর্শ হিসাবে কল্যাণের স্বরূপ আলােচনা করে।
(iii) সৌন্দর্যবিদ্যা অনুভবের আদর্শ হিসাবে সুন্দরের স্বরূপ আলােচনা করে।
(৬) ধর্ম-দর্শন বা ধর্মের দার্শনিক আলােচনা : ধর্ম জীবনের সত্যকে ধারণ করে রাখে। তাই ধর্ম সম্পর্কে মানুষ চিরদিনই আগ্রহী। ধর্মের প্রসঙ্গে ঈশ্বরের কথাও এসে পড়ে। তাই ঈশ্বর এবং ধর্ম-চেতনার স্বরূপ আলােচনার প্রয়ােজন হয়। দর্শনের অন্যতম শাখা হিসাবে ধর্ম-দর্শনে এই সব বিষয় সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য আলােচনা আছে।
(৭) সমাজদর্শন বা সমাজের দার্শনিক আলােচনা : সমাজ হল ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের একটি বাস্তবরূপ। তাই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির প্রকৃত সম্পর্ক কেমন ? এই সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা সামাজিক সংগঠনগুলির বৈশিষ্ট্য কি ? সমাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি ? এই সব নানা প্রশ্ন সামাজিক জীব হিসাবে মানুষের মনে জাগে। দর্শনের একটি শাখা হিসাবে সমাজদর্শন এই সব প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করে।
(৮) বাস্তব বিজ্ঞান-সংক্রান্ত আলােচনা : মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাস্তববিষয়ক নানা বিজ্ঞানের উৎপত্তি হচ্ছে। এই সব বিজ্ঞানের দার্শনিক তাৎপর্য দর্শনের বিষয়বস্তুর মধ্যে এসে গেছে। তাই বিষয়ের বৈচিত্র্য অনুযায়ী দশনে নতুন নতুন শাখার উৎপত্তি হচ্ছে। দর্শনের এই ধরনের শাখা হিসাবে রাষ্ট্রদর্শন (রাষ্ট্র-সম্পৰ্কীয় দার্শনিক আলােচনা), শিক্ষাদর্শন (শিক্ষা-সম্পৰ্কীয় দার্শনিক আলােচনা) প্রভৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে।
জ্ঞানের বিভিন্ন স্তর বা পর্যায়ঃ
জ্ঞান মানেই জানা। বস্তু বা বিষয়-জ্ঞানের তিনটি পর্যায় আছে-সাধারণ জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং দার্শনিক জ্ঞান। সাধারণ জ্ঞান হল নীচু মানের জ্ঞান। মানুষ তার চারপাশে দৃষ্টি মেলে বস্তু বা বিষয়কে নিজের মতাে করে জানতে চায়। এই জানা প্রথম অবস্থায় ইন্দ্রিয়-অনুভবের উপরেই নির্ভর করে। এই জ্ঞান ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই বিচ্ছিন্ন, অসংলগ্ন এবং অসম্পূর্ণ। এখানে প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস কাজ করে। এই ধরনের জ্ঞান হল সাধারণ জ্ঞান।
সাধারণ জ্ঞানে ঐক্যগঠনের কোনাে চেষ্টা নেই। এই চেষ্টা নিয়ে শুরু হয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা বিজ্ঞান। বিজ্ঞান বিচ্ছিন্ন সাধারণ জ্ঞানকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ করতে চায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও প্রকৃতির অন্তর্গত বস্তু বা বিষয়ের বাহ্য রূপের জ্ঞান। এখানে কাজের সুবিধার জন্য প্রকৃতিকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়। বিজ্ঞান একটি নয়, অনেক। এক একটি বিজ্ঞান প্রকৃতির এক একটি নির্দিষ্ট বিভাগের মধ্যে যে-সব সাধারণ নিয়ম আছে, সেগুলি অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করতে চায়। ফলে অসংলগ্ন সাধারণ জ্ঞান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই বিজ্ঞান হল সাধারণ জ্ঞানের সুসংহত রূপ। কিন্তু সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ হলেও বিজ্ঞান আসলে খণ্ড জ্ঞান বা বিভাগীয় জ্ঞান। বিজ্ঞানের ঐক্য আসলে খণ্ড ঐক্য।
দর্শন একদিকে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলির সত্যতা বিচার করে।অন্যদিকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলির ব্যাখ্যা দেয় এবং মূল্য বিচার করে। তাই দার্শনিক জ্ঞানকে জ্ঞানের চূড়ান্ত পর্যায় বলা চলে।
তা হলে দেখা গেল যে, সাধারণ জ্ঞানের সুসংহত রূপ হল বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের সামগ্রিক রূপ হল দর্শন। কাজেই সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে গুণগত কোনাে পার্থক্য নেই। পার্থক্য যেটুকু আছে, তা হল শুধুমাএ মাত্রাগত। সাধারণ জ্ঞান হল অসংগঠিত (unorgan ised ) জ্ঞান, বিজ্ঞান হল আংশিক সংগঠিত (partly organised) জ্ঞান এবং দর্শন হল সম্পূর্ণ সংগঠিত ( completely organised) জ্ঞান।
দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক (The relationship between philosophy and science):
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে বিষয়বস্তুগত ও পদ্ধতিগত নানা পার্থক্য আছে। কিন্তু এই সব পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলাই যায় সত্য লাভের লক্ষ্যে দর্শন ও বিজ্ঞান পরস্পর নির্ভরশীল এবং পরস্পরের পরিপূরক। দর্শনকে নিম্নলিখিত কারণে বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হয়।
দর্শন অবভাস ও স্বরুপ-দুই নিয়েই আলােচনা করে রদর্শন যখন অবভাস বা দৃশ্যমান জগতের আলােচনায় আসে, তখন তাকে বিভিন্ন বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়। কারণ, জড়, প্রাণ ও মনের বাস্তব অবস্থাসম্পর্কে নির্ভুল সিদ্ধান্ত বিভিন্ন বিজ্ঞানের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। কাজেই অবভাস সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় উপাদান বা তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে দর্শন বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানকে নিম্নলিখিত কারণে দর্শনের উপর নির্ভর করতে হয়-
(i) দেশ-কাল, দ্রব্য-গুণ, কার্য-কারণ প্রভৃতি প্রত্যয়কে বিনা বিচারে স্বীকার করে নিয়ে বিজ্ঞান তার অনুসন্ধান শুরু করে এবং এগুলির স্বরূপ নির্ধারণ শুধুমাত্র দর্শনের পক্ষেই সম্ভব।
(ii) বিজ্ঞানের খণ্ডজ্ঞান দর্শনের অখণ্ডতায় ঐক্যবদ্ধ হয়েই সার্থক পরিণতি লাভ করে। তাই বিজ্ঞানের আদিতেও দর্শন, অন্তেও দর্শন।
আরও পড়ুনঃ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনী