কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের বিবরণ | koutilyer Orthoshastr Texts Details

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের বিবরণ | koutilyer Orthoshastr Texts Details

■ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক রাজনীতি বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থের প্রণেতা মহামতি কৌটিল্য। ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে আমরা চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রীরূপে কৌটিল্যের উল্লেখ পাই। তাঁর অপর নাম বিষ্ণুগুপ্ত। আবার চাণক্য নামেও তিনি পরিচিত। জ্যাকোবি, ভিনসেন্ট স্মিথ, গণপতি শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কুটনীতিবিদ ব্রাহ্মণ মন্ত্রীকেই কৌটিল্য নামে চিহ্নিত করেছেন এবং এই কৌটিল্যই অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা।

পক্ষান্তরে ইয়োলী, ভিস্তারনিৎস, কীথ প্রভৃতি মনীষীগণ মনে করেন যে, কৌটিল্যের সিদ্ধান্তগুলিকে একত্রিত করে পরবর্তীকালে কোন শিষ্য বা শিষ্যসংঘ ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তবে অধিকাংশ আধুনিক সমালোচক মনে করেন যে, মগধের সিংহাসনে মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্তকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটি প্রণয়ন করেন। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রীরূপে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীই চাণক্যের স্থিতিকাল। ‘অর্থশাস্ত্র’ মোট পনেরটি অধিকরণে এবং ১৫০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত এক মহাগ্রন্থ।

❏ (১) বিনয়াধিকারিক নামক প্রথম অধিকরণে রাজার বিনয় ও বিদ্যাদি শিক্ষার বিষয় প্রতিপাদিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এই অংশেই আলোচিত হয়েছে। ইন্দ্রিয়জয়, অমাত্যনিয়োগ, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র বিষয়ে রাজার করণীয় কর্তব্য, দৃতপ্রণিধি, মন্ত্রণার প্রয়োজনীয়তা, আত্মরক্ষার উপায় প্রভৃতির বিস্তৃত বিবরণ।

❏ (২) দ্বিতীয় অধিকরণের নাম অধ্যক্ষপ্রচার। এই অধিকরণে আছে বিভিন্ন শাসনবিভাগের অধ্যক্ষদের কর্তব্যনির্ণয়। দুর্গাধ্যক্ষ, পণ্যাধ্যক্ষ, অস্ত্রাগারাধ্যক্ষ, শুক্লাধ্যক্ষ, অশ্বাধ্যক্ষ, রথাধ্যক্ষ প্রভৃতির বিভিন্ন কর্তব্য এখানে নির্দিষ্ট হয়েছে।

❏ (৩) ধর্মস্থীয় নামক তৃতীয় প্রকরণের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় দেওয়ানী আদালত বিষয়ক বিচারব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।

❏ (৪) কণ্টকশোধন নামক চতুর্থ প্রকরণে ফৌজদারী মামলা এবং সেই মামলায় প্রমাণিত অপরাধীদের বিভিন্ন শাস্তির বিধান নির্দিষ্ট হয়েছে।

❏ (৫) পঞ্চ ম প্রকরণের নাম যোগবৃত্ত। এই প্রকরণে গুপ্তচর প্রভৃতি গূঢ়পুরুষের আচরণীয় কর্তব্যের কথা বিবৃত হয়েছে।

❏ (৬) মণ্ডলযোনি নামক ষষ্ঠ প্রকরণে দ্বাদশ রাজমণ্ডলের বিবরণ এবং তাঁদের বিভিন্ন ইতিকর্তব্যতার কথা লিপিবদ্ধ আছে।

❏ (৭) ষাড়গুণ্য নামক সপ্তম প্রকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় হল — সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধীভাব ও সংশ্রয় এই ছয়টি গুণের প্রয়োগব্যবস্থা। পরবর্তী অধিকরণগুলির নাম যথাক্রমে—

❏ (৮) ব্যসনাধিকারিক,

❏ (৯) অভিযাসাৎকর্ম,

❏ (১০) সাংগ্রামিক,

❏ (১১) সংঘবৃত্ত,

❏ (১২) আবলীয়স,

❏ (১৩) দুর্গলভোপায়,

❏ (১৪) ঔপনিষদ এবং

❏ (১৫) তন্ত্রযুক্তি।

কৌটিল্য প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটি নানাবিধ জ্ঞাতব্যবিষয়ের আকর। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সচিবায়ত্ত সাম্রাজ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির যে অবস্থা মহামন্ত্রী হিসাবে কৌটিল্য লক্ষ্য করেছিলেন, নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ আদর্শ রাজ্যশাসনের সেই নীতিগুলি অর্থশাস্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রাচীন ভারতের রাজ্যশাসন পদ্ধতির এক পূর্ণাঙ্গ দলিল এই অর্থশাস্ত্র। সে সময় রাজতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজ্যশাসন পরিচালিত হতো মন্ত্রীমণ্ডলীর নির্দেশে।

সুতরাং রাষ্ট্র ছিল সচিবায়ত্ত, যা আধুনিক আমলাতন্ত্রেরই নামান্তর। সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষ নিযুক্ত হত। উপযুক্ত কর্মশক্তি পরীক্ষা করে রাজা বিভিন্ন বিভাগের অধ্যক্ষ নিয়োগ করতেন। নগরসমূহের শাসনভার নাগরিক নামক মহামাত্যের পর্যবেক্ষণে পরিচালিত হত।

শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রীকরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গ্রামাধ্যক্ষ পর্যন্ত রাষ্ট্রশাসনের ক্ষমতা বণ্টিত ছিল। তবে দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার সকল ব্যবহার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রাজাই ছিলেন চরম ক্ষমতার অধিকারী। অপরাধীকে দণ্ডদানের ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি লক্ষিত হলে রাজাও দণ্ডার্হ হতেন। এর দ্বারা অনুমিত হয় যে, কৌটিল্য তদানীন্তন রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজার একনায়কত্ব থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।

কৌটিল্যের সমসাময়িক সমাজের অনেক তথ্যও এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। তৎকালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। অর্থশাস্ত্রে বিধবাবিবাহকে প্রকারান্তরে অনুমোদন করা হয়েছে। রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপারে কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম প্রচলিত থাকলেও সমরবিশেষে রাজা বলপ্রয়োগে এমন কি অসদুপায়ে অধিক রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারতেন। তবে এই ব্যবস্থা কেবলমাত্র রাজকোষের অর্থাল্পতা দূর করার জন্য গৃহীত হত।

রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি ছাড়া আরও বহু তথ্য এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। এর থেকে কৌটিল্যের বিবিধ শাস্ত্রপারঙ্গমতার কথা জানা যায়। ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ কৌটিল্য রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পূর্বাচার্যদের মত অনুধাবন করে নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অর্থশাস্ত্রে ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পিশুন, কৌণপদন্ত, বাতব্যাধি, পরাশর প্রভৃতি পূর্বসূরীদের মতামতের উল্লেখ থেকে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, কৌটিল্যের পূর্বেও রাজনীতি বিষয়ক শাস্ত্রের প্রচলন ছিল। পূর্বাচার্যপ্রণীত সেই সকল শাস্ত্রের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্থশাস্ত্রের সর্বাতিশায়ী ইমারত। বিজিগীষ রাজার আদর্শ শাসনপ্রণালী ও ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে কৌটিল্যের অভিমত প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রশাসনের সহায়ক হয়েছিল।

অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ্ ম্যাকিয়াভেলির ‘The Prince’ গ্রন্থের সঙ্গে অর্থশাস্ত্রকে তুলনা করেছেন। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন তাত্ত্বিক চিন্তাবিদ্, আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হল বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজনীতির বিভিন্ন তত্ত্ব প্রয়োগের বিস্তৃত আলোচনায় সমৃদ্ধ এক অমূল্য গ্রন্থ। ধর্ম, অর্থ ও কাম — এই ত্রিবর্গের যথোপযুক্ত সেবা জীবনের লক্ষ্য হলেও রাজনীতিবিদ কৌটিল্য অর্থের সর্বাধিক গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। ম্যাকিয়াভেলির গ্রন্থটি হল রাজনীতির দর্শন, আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার দিগদর্শন।