ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী | Ishwarchandra Vidyasagar Biography in Bengali
[প্রবন্ধ-সংকেত:: ভূমিকা | জন্ম ও বংশপরিচয় | শিক্ষা | কর্মজীবন | সমাজসেবা | সাহিত্য সাধনা | উপসংহার]
■ ভূমিকা:- বাংলাদেশে এমন কোনো শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ নেই, যিনি বিদ্যাসাগরের নাম জানেন না। শিক্ষিত মানুষকে প্রথমে লেখাপড়া শিখতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছিল এবং অশিক্ষিত মহলে বিদ্যাসাগর প্রবাদ পুরুষ নামে খ্যাত। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে যে সকল মনীষীগণের আবির্ভাব হয়েছিল তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগর উদ্ধার ন্যায় বাংলা সাহিত্যকে চমকিত করেছিলেন। শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, গ্রন্থ সম্পাদক পাঠ্য পুস্তক রচয়িতা, স্রষ্টা সাহিত্যিক বিদ্যাসাগরের কর্মধারা বহুমুখী। বাংলা গদ্যের তিনি প্রথম সার্থক ও সচেতন শিল্পী।
■ জন্ম ও বংশপরিচয়:- ১২১৭ সনের ১২ ই আশ্বিন (ইং ১৮২০ খ্রীঃ ২৬ শে সেপ্টেম্বর) মঙ্গলবার মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয়, তখন বীরসিংহ ছিল হুগলী জেলার অন্তর্ভুক্ত, পরবর্তীকালে তা মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বিদ্যাসাগরের পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতার নাম ভগবতী দেবী। পিতামহ ছিলেন খ্যাতি সম্পন্ন পণ্ডিত রামজয় তর্কভূষণ। ঈশ্বরচন্দ্রের শ্বশুর ছিলেন প্রখ্যাত জমিদার ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য) । ঈশ্বরচন্দ্রের সহধর্মিনী দীনময়ী দেবী।
■ শিক্ষা:- ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্য ও শৈশব8 কেটেছিল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। এই দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি গ্রামের পাঠশালায় পণ্ডিত কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নিকট বাল্য শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বাল্যশিক্ষা শেষ করে তিনি ১২৩৫ সনে মাত্র নয় বছর বয়সে পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে। এখানে তিনি সংস্কৃত কলেজে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। দীর্ঘ বার বছর এই কলেজে কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্র মনোযোগ সহকারে প্রতিটি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে সফল হন। এবং শেষ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হবার জন্যে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সেই সঙ্গে তিনি পুরস্কার পেয়েছিলেন ৮০ টাকা। ১৮৩৯ খ্রীঃ তিনি হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষাতেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হন।
■ কর্মজীবন:- বিদ্যাসাগর ১৮৪১ খ্রীঃ ২৯ শে ডিসেম্বর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এত কম বয়সে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ জি.টি মার্শাল সাহেবের প্রচেষ্টায় বাঙালীদের মধ্যে বিদ্যাসাগরই পঞ্চাশ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদ অলঙ্কিত করেন। কিন্তু কলেজ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি ঐ পদে ইস্তফা দেন। ১৮৫০ খ্রীঃ জি.টি.মার্শাল সাহেবের তৎপরতায় তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন।
১৮৫১ খ্রীঃ ২২ শে জানুয়ারী মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে অধ্যক্ষ্যের পদে নিযুক্ত হন। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের নিষ্ঠাবান কর্মে মুগ্ধ হয়ে মাসিক বেতন ধার্য করেছিলেন ৩০০ টাকা। সে সময় তিনি অতিরিক্ত কাজ হিসাবে গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় পরিদর্শকের কর্মভার গ্রহণ করেছিলেন।
■ সবাজসেবা:- শিক্ষাব্রতী বিদ্যাসাগর গ্রামাঞ্চলে পরিদর্শনকালে শিক্ষার অভাবে মানুষের অন্ধকারে ডুবে থাকা মর্মপীড়া অনুভব করেছিলেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি দেশের নানা স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন এবং শিক্ষামূলক পুস্তক রচনা শুরু করলেন। ১৮৫৫-৫৮ খ্রীঃ মধ্যে তিনি বাংলার চারটি জেলায় ২০ টি Model School এবং পাঁচটি Normal School স্থাপন করেন।
তখনকার সমাজে স্ত্রী শিক্ষা ছিল অবহেলিত, তিনি নিজের উদ্যোগে ১৮৫৭-৫৮ খ্রীঃ মধ্যে ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং বহুকাল এই বিদ্যালয়গুলির ব্যয় ভারও বহন করেছিলেন। উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপনে বিদ্যাসাগরের কীর্তি অনন্য। মধ্য কলকাতার শঙ্কর ঘোষ লেনে কয়েকজন বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথমে সাধারণ সদস্য এবং পরবর্তীকালে প্রধান সম্পাদকের পদ লাভ করেন। ১৮৬৪ খ্রীঃ এই বিদ্যালয়টি নতুন নামকরণ করেন হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনষ্টিটিউশন, বর্তমানে এই কলেজটির নাম বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয়। সমাজসংস্কারক রূপে বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ সালে বিধবা-বিবাহ আন্দোলন শুরু করেন। হিন্দু বিধবাদের মর্মান্তিক দুর্দশা ঘোচাতে তিনি জন মার্শালের সহযোগীতায় ১৮৫৬ সালের ২৭ শে জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ করতে সফল হন।
এছাড়াও সমাজ কল্যাণের উদ্দেশ্যে ১৮৬৫ ও ৬৬ খ্রীঃ উড়িষ্যা ও দক্ষিণবঙ্গ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি দীর্ঘ ছ’মাস দুর্ভিক্ষ পীড়িত নর-নারীকে অন্নদান করেছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টাতে ছোট সাহেব বেসিন বিডন সাহেব ওই দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা, রামজীবনপুর, শ্যামবাজার প্রভৃতি অঞ্চলে অন্নছত্র খুলে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন বিদেশে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন তিনি তাকেও সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।
■ সাহিত্য সাধনা:- বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক। তাঁকে বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ আক্ষায় শিল্পী ভূষিত করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রধানত সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরাজী থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন, তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস, বেতাল পঞ্চবিংশতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এছাড়াও ‘মহাভারত’, ‘উপক্রমণিকা’, ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’, ‘কথামালা’, ‘বোধদয়’ , শকুন্তলা, আখ্যানমঞ্জুরী, (তিনটি ভাগে বিভক্ত), বর্ণপরিচয়, প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থগুলি আজও শিক্ষার অপরিহার্য সহায়ক বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও বিদ্যাসাগরের শিক্ষামূলক আরও কয়েকটি গ্রন্থ হল রামের রাজ্যাভিষেক, শব্দ মঞ্জুরী, ‘শ্লোক মঞ্জুরী’, শব্দ সংগ্রহ, নীতিবোধ, ব্রজবিলাস, বাংলার ইতিহাস, রত্ন পরীক্ষা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
■ উপসংহার:- ১৯৮০ খ্রীঃ ভারত সরকার প্রদত্ত C. I. E. উপাধিতে সম্মানিত ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শেষ বয়সে নানা কারণে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বাকী জীবন বিহারের অন্তর্গত কার্মাটারে অতিবাহিত করেন। ১২৯৮ সনের ১৩ ই শ্রাবণ (১৮৯৮, ২৯ শে জুলাই) তিনি পরলোকগমন করেন, কিন্তু আজও প্রতিনিয়ত বাঙালী হৃদয়ে তিনি জীবিত আছেন।