প্রবন্ধ রচনা- ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বর্ষ-পূর্তি | Seventy-Five Years of Indias Independence Essay Writing in Bengali

ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বর্ষ-পূর্তি | Seventy-Five Years of Indias Independence Essay Writing in Bengali

[প্রবন্ধ সংকেত :: ভূমিকা | অতীতের স্মৃতিরোমন্থন | মনীষী কবি-সাহিত্যিক তথ সংবাদপত্রের দান | আটান্ন বছরের ঘটনা পঞ্জী | উন্নয়নের বহুবিধিচিত্র | ব্যর্থতা | উপসংহার]

“মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান”

■ ভূমিকা:- সেই সমস্ত উৎসর্গীকৃত প্রাণ, ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান যথার্থ মূল্যে ভূষিত হল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের মুক্তিযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সফল হল। সেই দিন ভারত স্বাধীন হল। তারপর অতিক্রান্ত হল ৭৫ টি বছর। আর দু বছর পরই ষাট বছর স্বাধীনতার উৎসব পালিত হবে। এই ষাট বছর পূর্তিতে আমরা পিছু ফিরব পরাধীন ভারতের দিকে, চোখ দেব নতুন ভারতে, কী চেয়েছিলাম …….. কী পেলাম ….. এই চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিকাশ করবো আর প্রত্যাশার ছবি আঁকবো।

■ অতীতের স্মৃতি রোমন্থন:- অতীত স্মৃতি রোমন্থনে ভেসে ওঠে কত কথা। মনে পড়ে ১৮৫৭ সালে পলাশিতে বীর সিরাজদ্দৌলার কথা। ১৮৭৫ সালে ভারতের মহাবিদ্রোহের নায়ক-নায়িকাদের কথা — মঙ্গলপাণ্ডে, আহমদ আলী, লক্ষ্মীবাঈ। আরও কত শহিদ। পরবর্তী কালে ইংরেজ শাসকবৃন্দ সর্বদাই বিব্রত থেকেছে সূর্য সেন, সাভারকার, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী প্রমুখ অগণ্য প্রাণতুচ্ছ করে বিপ্লবীদের জন্য।

■ মনীষী, কবি সাহিত্যিক তথা সংবাদপত্রের দান:- এতদ্ব্যতীত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবন তথা ভারতকে স্বাধীনতার আস্বাদ দিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করেছেন অগণিত মনীষী, কবি, সাহিত্যিক এবং বেশ কিছু সংবাদ পত্র। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, গোখলে, তিলক, বদরুদ্দিন তায়েবজি, চিত্তরঞ্জন, ভগিনী নিবেদিতা। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুদ্ধের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, রঙ্গলালের পলাশির যুদ্ধ আমাদের অনুপ্রাণিত করে তোলে।

স্বতন্ত্রভাবে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্র এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে হিন্দু পেট্রিয়ট, অমৃতবাজার, দি হিন্দু, স্বদেশ মিত্রম্ প্রভৃতি নিৰ্ভীক পত্র-পত্রিকার কথা। এইভাবেই বহু মানুষের বহু প্রতিষ্ঠানের একক এবং সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় ভারত লাভ করল বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতালাভের পর কেটে গেল দীর্ঘ ৫৭ বছর। খুব শীঘ্রই ষাট বছরে পদার্পণ করবে আমাদের স্বাধীনতা। আজ এই মুহূর্তে নবীন প্রজন্মকে অতীত ইতিহাস জানতেই হবে।

■ দীর্ঘ আটান্ন বছরের ঘটনাপঞ্জী:- স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় পাঁচ দশক কেটে যাবার পর আজ ফেলে আসা ওই সব বছরের সাল লক্ষ করলে বিমিশ্র অনুভূতি হয়। অনেককেই বলতে শুনি, নেতাজীর স্বপ্ন, গান্ধিজির আদর্শ, জহরলালের প্রতিশ্রুতি, লালবাহাদুরের সংক্ষিপ্তকালীন কর্মোদ্যোগ, ইন্দিরা গান্ধির জাতীয়তাবাদী কর্মসূচির ধারা সবই ভেসে গেছে এই ক-বছরে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া নাকি আমরা কিছুই পাইনি। এইসব কথা আংশিক সত্য। আজকের ভারত গভীর সংকটে আবর্তিত হলেও আমাদের প্রাপ্তি কিছু কম নয়।

ভারত এমন পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্ররূপে পৃথিবীতে তার স্বীকৃতি বিভিন্ন-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফল রূপায়নের ফলে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভূতপূর্ব উন্নতি। জনসংখ্যার অর্ধাংশের বেশি সাক্ষর। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত অনুসৃত হচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, বৃহৎ শিল্প গড়ে উঠেছে, প্রযুক্তি বিদ্যার অসাধারণ প্রসার ঘটেছে — আমরা পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছি। আমাদের পারিবারিক জীবন আজ স্বচ্ছন্দ এবং আনন্দময় হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন ভোগ্য বস্তুর সহজ প্রাপ্তিতে। কায়িক পরিশ্রম লাঘব হয়েছে অনেকাংশে।

■ উন্নয়নের বহুবিধ চিত্র:- প্রাসঙ্গিক ভাবে উঠে আসে আরো কিছু স্মরণীয় কথা, লক্ষণীয় ঘটনা। খোরানা, মাদার টেরিজা, সুব্রয়নের, অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার, আর্যভট্টের মহাকাশ যাত্রা, তেনজিং -এর এভারেস্ট বিজয় কলকাতায় পাতাল রেল চালু। অর্থনৈতিক দিক থেকে রেল-বিমান-ব্যাংক জাতীয় করণ, ডাঙ্কেল প্রস্তাব গ্রহণ ও মুক্ত অর্থনীতি ঘোষণা। এছাড়াও রয়েছে চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের ‘অস্কার’ লাভ। খেলাধুলার জগতেও ভারতের নাম কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।

১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়, টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং -এ গাভাসকর এবং বোলিং -এ কপিলদেবের বিশ্বরেকর্ড, ব্যাডমিন্টনে প্রকাশ পাড়ুকন, ১৯৯৬ অলিম্পিকে টেনিসে লিয়েন্ডার পেজের পদক লাভ, আলিম্পিক ২০০৪ -এ রাজ্যবর্ধন রাঠোর সুটিং -এ ব্রোঞ্জ পেয়েছেন। রচনার অল্প পরিসরে বাদ পড়ে যায় আরো অনেক উল্লেখযোগ্য বিষয়।

■ ব্যর্থতা:- আলো যেমন আছে, অন্ধকারও থাকবে, তাই স্বাভাবিক। আমরা দেখেছি তীব্র বেকারত্ব, দারিদ্র্য, জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধি এবং তজ্জনিত বহু অসুবিধে আমাদের নিরন্তর পীড়িত করেছে। এতদিনেও সাম্প্রদায়িক হানাহানি, উগ্রপন্থা, বিচ্ছিন্নতাবাদ রোধ করা গেল না। সমাজের সর্বত্র যেন মূল্যবোধহীনতার কালো ছায়া গ্রাস করতে চাইছে।

■ উপসংহার:- তবু বলি এই সব সাফল্য ও ব্যর্থতা মিলিয়েই আজ আমরা স্বাধীনতার ষাট বছর পূর্তিতে খুব শীঘ্রই চতুর্দিকে অনুষ্ঠান করব। একটা কথা মনে রাখতেই হবে মুক্তির আনন্দে বিহঙ্গের মতো ভেসে গেলেই চলবে না, উৎসব আড়ম্বরে ষাট বছর পালন করে দায়িত্ব শেষ হল ভাবাও অন্যায়। মনে রাখতে হবে স্বদেশপ্রেমিক, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় উল্লিখিত সতর্কবাণী আজও প্রাসঙ্গিক ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিতে কোন্ বলিদান? আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ’? অনেক শহিদের রক্তে রাঙা স্বাধীনতা যেন আমরা মূল্য দিতে পারি, জাত নয় জাতিকে যেন তুলে ধরতে পারি বিশ্বের মাঝে। তবেই স্বাধীনতার যে কোনো বর্ষপূর্তি সার্থক হবে।