মানবপ্রেমিক হাজি মোহম্মদ মহসিন | Haji Mohammad Mohsin Biography in Bengali
[প্রবন্ধ সূত্র :: ভূমিকা | জন্ম ও বাল্য কাল | দেশভ্রমন | অর্থলাভ | মানহিতকর কার্যাবলী — ইমামবারা নির্মান | চরিত্র বৈশিষ্ট্য | উপসংহার]
■ ভূমিকা:- যুগে যুগে যে সকল মহামানব মানুষকে ভালোবেসে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের কল্যাণকর্মে, মানবকল্যাণকে গ্রহণ করেছেন মানবধর্মরূপে হাজি মোহম্মদ মহসিন তাদের অন্যতম। বাঙালি জাতি ও বাংলার জন্য তাঁর অবদান তাঁকে করে রাখবে চিরস্মরণীয়।
■ জন্ম ও বাল্যকাল:- ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে মহসিনের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম হাজি ফৈজুল্লা। মহসিন প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন শিবাজি নামে এক মপ্রাণ মৌলবির তত্ত্ব বধানে। তারপর তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য গমন করেন- রশিদাবাদ। সেখানে আরবি ও ফারসি ভাষায় বিশেষ জ্ঞান লাভ করে ফিরে আসেন হুগলিতে।
■ দেশ ভ্রমণ:- মহসিন বাল্যকাল থেকেই গভীর ঈশ্বর বিশ্বাসী। এই ঈশ্বরে যক্তি ও বিশ্বাস তাঁকে সাংসারিক জীবন সম্পর্কে করেছিল উদাসীন। তিনি দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে আরব, পারস্য, মিশর, তুর্কিখান প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে। হিজগৎ সম্পর্কে অর্জন করলেন ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান। তারপর মক্কা ও মদিনা তীর্থকৃত্য সমাপ্ত করে ‘হাজি’ উপাধি লাভ করে দেশে ফিরে এলেন। তাঁর “মিপ্রাণ হৃদয় ব্যাপক দেশ ভ্রমণের ফলে আরও অভিজ্ঞ ও উদার হয়ে পড়েছিল।”
■ অর্থলাভ:- হাজি মহসিনের ভগিনীর নাম ছিল মন্নুজান। তিনি ছিলেন অগাধ সম্পত্তির মালিক। মহসিন যখন দেশ ভ্রমণ করছিলেন, তখন তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে নি সমস্ত সম্পত্তি মহসিনকে দান করেন। এইভাবে মহসিন অধিকার লাভ করেন বিশাল সম্পত্তির।
■ মানবহিতকর কার্যাবলি:- মহসিনের অর্থ বা সম্পত্তির প্রতি ছিল না কোনো আকর্ষণ। তার প্রকৃতি ছিল সাধু-সন্ন্যাসীর মতো। তিনি এই বিপুল সম্পত্তি মানবহিতকর কার্যে নিয়োজিত করতে মনস্থ করলেন। তিনি দেখেছিলেন হাজার হাজার মানুষ রোগে ভোগে, তাদের ঔষধ নেই, পথ্য নেই, নেই কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা। অসংখ্য মানুষের জন্য কোনো শিক্ষাব্যবস্থা নেই হাজার হাজার ছাত্র অর্থাভাবে ও স্থানভাবে শিক্ষালাভের সুযোগ পায় না। মহসিন এই সব আর্ত মানুষদের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে লাগলেন। হাজার হাজার অসহায় ছাত্রকে তিনি অর্থ সাহায্য করতেন। কোনো প্রার্থী তার কাছ থেকে বিফল হয়ে ফিরে যেতো না।
■ ইমামবাড়া নির্মাণ:- মহসিন হুগলিতে ইমামবাড়া নামে তৈরি করলেন এক বিশাল প্রসাদ। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হল অতিথিশালা চিকিৎসালয়, ধর্মমন্দির ও শিক্ষালয়। দরিদ্র রোগীরা এখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ পেল। ধার্মিক মুসলমানগণ এখানে নিশ্চিত্তমনে ঈশ্বরচিন্তা করেন। মহসিন মুলসমান ছাত্রদের শিক্ষার জন্য দান করে গেলেন এক লক্ষ ছাপান্ন হাজার টাকা আয়ের সম্পত্তি। গঙ্গার তীরে বিশাল ইমামবাড়া হুগলির অন্যতম দর্শনীয় তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এখানে এলে মহামানব হাজি মোহম্মদ মহসিনের অপূর্ব মানবপ্রেমিক মূর্তি যেন চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
■ চরিত্র বৈশিষ্ট্য:- হাজি মোহম্মদ মহসিন ছিলেন উদার মহাপ্রাণ ও মানবতাবাদী মহামানব। তিনি তাঁর সর্বস্ব মানবকল্যাণে উৎসর্গ করে রেখে গিয়েছেন মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে এই দানবীর মানব প্রেমিক পরলোক গমন করেন। তাঁর নির্মিত ইমামবাড়া চিরদিন তাঁর কীর্তি ও মহিমার স্মারক হিসাবে সগৌরবে বিরাজমান, শুধু ইমামবাড়া নয়, মোহম্মদ মহসিন চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর প্রেম প্রীতি ও সৌহার্দ্যের জন্য। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলমানের মিলনকামী, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে তিনি এক অভিনব উদারতার আদর্শ প্রচার করে গিয়েছেন।
■ উপসংহার:- জাতীয় জীবনে যাঁরা নিজস্ব কীর্তির মধ্যেই চিরজীবী হয়ে আছে। হাজী মোহম্মদ মহসিন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সাধারণ মানুষের মতো অতি জটিলযুগে হাজী মোহম্মদ মহসিনের জীবনাদর্শ সর্বতোভাবে অনুসরণ করা কর্তব্য। তিনি তাঁর জীবন সাধনার যে পরিচয় রেখে গিয়েছেন, তার মধ্য দিয়েই সমগ্র জাতি নতুন জীবন মন্ত্রে সঞ্জীবিত হবে। তাঁর প্রদর্শিত পথেই জাতি আবার গৌরব ও গরিমার অধিকারী।