বাংলা নাটকে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান | Girish Chandra Ghosh’s Contribution Bengali Drama

বাংলা নাটকে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান | Girish Chandra Ghosh’s Contribution Bengali Drama

❏ প্রশ্ন:- বাংলা নাটকে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো। (Girish Chandra Ghosh’s Contribution Bengali Drama)

উত্তর:- দীনবন্ধু মিত্রের পরবর্তী কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১) বাংলা নাট্য জগতকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ নাট্যকার ও প্রয়োগশিল্পী। তাঁর প্রচেষ্টাতেই বাঙালী দর্শক সর্বপ্রথম প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিল। ‘প্রথমে অভিনেতারূপে আত্মপ্রকাশ করে তিনি অন্যের লেখা নাটক অভিনয় করতেন, পরে নিজেই নাট্য রচনা শুরু করেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রভৃতির নাট্য রূপদানকালে তিনি নাটক রচনার কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। পরে বিভিন্ন রঙ্গালয়ে অভিনয়ের তাগিদে তাঁর নাটকগুলির রচিত হয়। তাঁর অধিকাংশ নাটকেই গভীর ভক্তিরসের প্রবাহ। ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্ত নাটক রচনার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র থেকে

গিরিশচন্দ্রের ‘প্রফুল্ল’ নাটক বিয়োগান্তক নাটকগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও মঞ্চসফল। গিরিশচন্দ্র শুধু নাট্যকার নন, বাংলার নাট্যমঞ্চ, অভিনয় – শিল্প ইত্যাদির পরিচালনায় তিনি ছিলেন অগ্রণী পুরুষ। “ন্যাশানাল থিয়েটার” (বর্তমানে স্টার) প্রতিষ্ঠা তাঁর জীবনের অন্যতম কীর্তি। গিরিশচন্দ্র প্রতিভাবান নাট্যকার হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের চাহিদা অনুযায়ী নাটক রচনা করায় তাঁর নাটকের নাট্যগুণ খর্ব হয়েছে।

তবে ভক্তিরসের প্রাবল্য ও জাতীয়তাবোধের প্রকাশে তাঁর অধিকাংশ নাটক প্রাণবন্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া তৎকালীন প্রসিদ্ধ অভিনেতাদের অভিনয়-প্রতিভার দিকে লক্ষ্য রেখেও তাঁকে নাটকের চরিত্র সৃষ্টি করতে হয়েছে। প্রহসন, রূপক, নকশা ইত্যাদি রচনাও তাঁর নাট্যপ্রতিভার এক দিক।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্যে এসে গিরিশচন্দ্রের জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে গিয়েছিল। ভোগী গিরিশচন্দ্র যোগী গিরিশচন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। এই সময়ের নাটকগুলিতে ভক্তিরসের প্রাবল্য ও করুণরসের আতিশয্য দেখা যায়। গিরিশচন্দ্রের নাটকের বিষয়বৈচিত্র্য, অসামান্য। তিনি যে কত বিষয় অবলম্বনে নাটক রচনা করেছেন, তার ইয়াত্তা নেই। পৌরাণিক, সামাজিক এবং বীররসমিশ্রিত ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে তিনি নাটক লিখেছেন।

গিরিশচন্দ্র প্রথমে ‘আনন্দ রহো’ (১৮৮১) নামক মৌলিক নাটক লেখা শুরু করেন। এর মধ্যে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু থাকা সত্ত্বেও নাটক হিসাবে এটি সার্থক হয়নি। এরপর তিনি ভক্তিরসাত্মক পৌরাণিক নাটক লেখা শুরু করেন। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর লেখা ‘রাবণবধ’ নাটকটি মঞ্চসফল হয়। এরপর একে একে রচনা করেন ‘সীতাহরণ’ (১৮৮২) প্রভৃতি পৌরাণিক নাটক।

এই নাটকগুলি সেযুগের বাঙালীর ভক্তিভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল বলে এগুলি প্রচুর জনপ্রিয় হয়েছিল। নাটকের মধ্যে দেবতার অলৌকিক মহিমা, ভক্তিরসের উচ্ছ্বাস, পাপের পরাজয়, পুণ্যের শক্তি প্রভৃতি বিষয় দেখিয়ে তিনি বাঙালীর মনোরঞ্জন করেছিলেন। তাঁর পৌরাণিক নাটক ‘জনা’ (১৮৯৪) সকল দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। বিষয়বস্তু, চরিত্রসৃষ্টি, নাট্যসংঘাত এবং সংলাপ রচনা — সকল দিক দিয়েই এই নাটকে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে।

গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকে ভক্তহৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। পৌরাণিক নাটকের জন্য গিরিশচন্দ্র মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দ ভেঙ্গে নাটকে এক ধরনের নতুন ছন্দ ব্যবহার করেন। এই ছন্দই ‘গৈরিশ ছন্দ’ নামে পরিচিত। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে গিরিশচন্দ্রের আসন প্রথম শ্রেণীতে, একথা বিনা দ্বিধায় বলা চলে।

গিরিশচন্দ্র অবতারকল্প মহাপুরুষদের জীবনী অবলম্বনে যে সকল নাটক রচনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে ‘চৈতন্যলীলা’ (১৮৮৪), ‘নিমাই সন্ন্যাস’ (১৮৮৪), ‘বুদ্ধদেব-চরিত’ (১৮৮৯), ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। জীবনের শেষ পর্যায়ে জাতীয় ভাবধারায় সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষের মনে দেশাত্মবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি রচনা করেন ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৯০৬), ‘মীরকাশিম’ (১৯০৬), ‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৯০৭), ‘অশোক’ (১৮৯১), ‘সত্নাম’ (১৯০৪)। এই সমস্ত ঐতিহাসিক নাটকে গিরিশচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম ও ঐতিহাসিকবোধ লক্ষ্য করা যায়।

অবশ্য তিনি ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক হয়েও ইতিহাসের ঘটনাকে নিপুণ – ভাবে অনুসরণ করেননি। ‘সিরাজদ্দৌলা’ ও ‘মীরকাশিমে’ র আখ্যানভাগ গ্রন্থনে মৌলিক উৎসের সন্ধান না দিয়ে তিনি শুধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের দু’খানি গ্রন্থকে একমাত্র অবলম্বনরূপে জ্ঞান করেছিলেন। অকারণে স্বাদেশিক উচ্ছ্বাস, স্থান কাল পাত্রের অনৈতিহাসিকতা, অতিনাটকীয়তা, বাস্তববোধের অভাব ইত্যাদির ফলে তাঁর নাটক যথার্থ ঐতিহাসিক নাটক হতে পারেনি।

গিরিশচন্দ্রের সামাজিক নাটকের মধ্যে ‘প্রফুল্ল’ (১৮৮৮), ‘হারানিধি’ (১৮৯০) ‘বলিদান’ (১৯০৫), ‘শাস্তি কি শান্তি’ (১৯০৮), ‘মায়াবসান (১৮৯৮) প্রভৃতি বিখ্যাত। ‘মদ্যাসক্তি, পারিবারিক বিরোধ, ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, কুমারী ও বিধবার বিবাহ সমস্যা, লাম্পট্য, জালজুয়াচুরি, মামলা মোকদ্দমা — এই বিষয়গুলি তাঁর পারিবারিক নাটকে ঘুরে ফিরে এসেছে। এই সকল নাটকের মধ্যে ‘প্রফুল্ল’ নাটকটি তৎকালে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

এর মধ্যে যোগেশ চরিত্রে গিরিশচন্দ্রের অসামান্য অভিনয় এক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ‘বলিদান’ নাটকে বাঙালী সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বিবাহ সমস্যা ও বিবাহ পরবর্তী ট্র্যাজেডি বর্ণনা হয়েছে। তাঁর সামাজিক নাটকগুলিতে গার্হস্থ্য সমস্যা প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে নাট্যকারের সমাজবোধের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। গিরিশচন্দ্রের নাটকে অনেক ত্রুটি আছে সত্যি, কিন্তু তিনি বাংলা নাট্যধারাকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।