পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় বিষয় এক নজরে | General Knowledge Westbengal Questions Answers

পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় বিষয় এক নজরে | General Knowledge Westbengal

■ পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক হলো: ২৫.৩৭° উত্তর ৮৫.১৩° পূর্ব।

পশ্চিমবঙ্গের হলো একটি প্রজাতান্ত্রিক প্রদেশ। বঙ্গদেশের পশ্চিমাংশে অবস্থিত বলে এর নাম পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল যখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গ নামটি গৃহীত হয়েছে। সেই সময় এর ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছিল West Bengal (ওয়েস্ট বেঙ্গল)। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের ইংরেজি নামটি পালটে Paschimbanga রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর নাম কলকাতা।কলকাতা হলো ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম মহানগর। এছাড়া উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি রাজ্যটিও অপর একটি অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মহানগর। শিলিগুড়ি করিডোরে অবস্থিত এই শহর উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে অবশিষ্ট দেশের সংযোগ রক্ষা করে আছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য মহানগরীগুলো হলো‒ আসানসোল, দুর্গাপুর, হাওড়া, রাণীগঞ্জ, হলদিয়া, জলপাইগুড়ি, খড়গপুর, বর্ধমান, দার্জিলিং, মেদিনীপুর, তমলুক, ইংরেজ বাজার ও কোচবিহার প্রভৃতি ।

■ পশ্চিমবঙ্গের সীমানা:-

ভারতের অন্যান্য রাজ্য এবং বাংলাদেশের ভিতরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি একটি সংকীর্ণ অবয়ব ধারণ করে আছে। পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গকিলোমিটার (৩৪,২৬৭ বর্গমাইল)। রাজ্যের উত্তরে সর্বোচ্চস্তরে অবস্থান করছে দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল। এই অঞ্চল পূর্ব হিমালয়ের একটি অংশ। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু (৩,৬৩৬ মিটার বা ১১,৯২৯ ফুট) এই অঞ্চলেই অবস্থিত। এই পার্বত্য অঞ্চলটি দক্ষিণে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে সংকীর্ণ তরাই অঞ্চল দ্বারা। অন্যদিকে রাঢ় অঞ্চল গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলটিকে বিচ্ছিন্ন করেছে পশ্চিমের মালভূমি ও উচ্চভূমি অঞ্চলের থেকে। পশ্চিমবঙ্গের সর্বদক্ষিণে একটি নাতিদীর্ঘ উপকূলীয় সমভূমি অবস্থান করছে। অন্যদিকে সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ অরণ্য পরিবেষ্টিত করে আছে গাঙ্গেয় বদ্বীপের অংশবিশেষ।

■ পশ্চিমবঙ্গের ভূমিরূপ:-

পশ্চিমবঙ্গের ভূমি বেশ বৈচিত্র্যময়। এর উত্তরাংশে রয়েছে হিমালয় -এর পার্বত্য অঞ্চল, আর দক্ষিণে গঙ্গা-বিধৌত পললভূমি। এর মাঝে আছে আর্দ্র তরাই অঞ্চল এবং শুষ্ক রাঢ় অঞ্চল। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পশ্চিমবঙ্গকে ৫টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগগুলো হলো−

● (১) দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল,

● (২) তরাই অঞ্চল,

● (৩) উত্তরবঙ্গ সমভূমি,

● (৪) রাঢ় অঞ্চল এবং

● (৫) উপকূলীয় সমভূমি।

❏ দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল:-

এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে পূর্ব হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্গত দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। সমগ্র দার্জিলিং জেলা (শিলিগুড়ি মহকুমা ছাড়া) এবং জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর দিকের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলটি তরাই অঞ্চলের ঠিক উত্তর দিকে অবস্থান করছে। উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত তিস্তা নদীর গভীর উপত্যকাটি এই পার্বত্য অঞ্চলকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। এই দুটি ভাগ হলো সিঙ্গালিলা এবং দার্জিলিং পর্বতশ্রেণী। সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণী দার্জিলিং ও নেপালের সীমান্ত বরাবর অবস্থিত।

এই পর্বতশ্রেণীতেই অবস্থিত চারটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। এই শৃঙ্গগুলি হলো− সান্দাকফু, ফালুট, সবরগ্রাম ও টংলু। সান্দাকফু হলো (৩,৬৩৬ মিটার (১১,৯২৯ ফুট) পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। দার্জিলিং শহরের কাছে টাইগার হিল ও ঘুম নামের দুইটি শৃঙ্গ রয়েছে। টাইগার হিল থেকে বিভিন্ন পর্বতশ্রেণী বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে আছে। পূর্বভাগের অবস্থিত দার্জিলিং পর্বতশ্রেণীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শৃঙ্গ হল দুরপিনদারা। এছাড়াও হিমালয়ের পাদদেশে তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলে কয়েকটি পাহাড় দেখা যায়। জলপাইগুড়ি জেলায় শিবালিক পর্বতশ্রেণীর কিছু অংশ আছে, এর নাম হলো বক্সা-জয়ন্তী পাহাড়।
 
■ তরাই অঞ্চল:-

‘তরাই’ কথাটির অর্থ হলো আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে অঞ্চল। এটি মূলত হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত জলাভূমিময় তৃণভূমি অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার সমভূমি অঞ্চল শিলিগুড়ি মহকুমা, জলপাইগুড়ি জেলা এবং কোচবিহার জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে এই তরাই অঞ্চল গঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলটির উত্তরে হিমালয়ের পাথর, নুড়ি আর ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি দ্বারা তৈরি বনময় ভাবর অঞ্চল অবস্থিত।

এই অঞ্চলের মাটিতে কাদা ও বালির পর্যায়ক্রমিক স্তর লক্ষ্য করা যায়। এখানকার ভূ-জলপৃষ্ঠ বেশ উচ্চ। ফলে এই অঞ্চলটিতে অনেক ঝোরা ও জলভূমি দেখা যায়। তরাই অঞ্চলের নদীগুলিতে বর্ষাকালে বন্যা দেখা যায়। তরাই-ডুয়ার্স সাভানা এবং তৃণভূমি একটি বাস্তু-অঞ্চল আছে। এই অঞ্চলটি গোটা তরাই অঞ্চলের মধ্যভাগ জুড়ে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলে লম্বা লম্বা ঘাসযুক্ত ভূমি লক্ষ্য করা যায়। এই অঞ্চলটিতে চিরহরিৎ ও পর্ণমোচী বনভূমিও দেখা যায়। এখানকার ভূমির ঢাল উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে, এবং এই ঢালও খুব বেশি নয়। ভূমিভাগের সাধারণ উচ্চতা প্রায় ৮০-১০০ মিটার। তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, সঙ্কোশ প্রভৃতি বড়ো নদীর এবং একাধিক ছোট নদীর বয়ে আনা বালি, নুড়ি ও পাথর দ্বারা গড়ে উঠেছে এই তরাই অঞ্চল।
 
■ উত্তরবঙ্গ সমভূমি:-

তরাই অঞ্চলের দক্ষিণ দিক থেকে গঙ্গার বাম তীর পর্যন্ত অঞ্চলটি উত্তরবঙ্গ সমভূমি অঞ্চল নামে পরিচিত। জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাঞ্চল, উত্তর দিনাজপুর জেলা (উত্তরের কয়েকটি অংশ বাদে), দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, মালদহ জেলা ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে এই সমভূমি গঠিত হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের যে সংকীর্ণ ভূখণ্ডটি মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সঙ্গে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার সংযোগ রক্ষা করছে, সেটির নাম মহানন্দা করিডোর। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের সমস্ত অঞ্চলই পলল গঠিত সমভূমি।

মহানন্দা নদী মালদহ জেলাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। এর পূর্বাংশটি প্লাবন সমভূমি নামে পরিচিত। এটি পুরনো পলিমাটি দ্বারা গঠিত। এখানে কয়েকটি টিলাও লক্ষ্য করা যায়। এই অঞ্চলটি বরেন্দ্রভূমি নামেও পরিচিত এবং এটি গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের অংশবিশেষ। পশ্চিমাংশটি নতুন পলিমাটি দ্বারা গঠিত। এই অংশেই কালিন্দী নদী মহানন্দা নদীতে মিশেছে। মালদহের কালিন্দী নদীর উত্তরে অবস্থিত ভূমিভাগটি তাল নামে পরিচিত। এটি একটি নিম্নসমভূমি। এখানে অনেক জলা ও বিল লক্ষ্য করা যায়। কালিন্দী নদীর দক্ষিণে অবস্থিত উর্বর অংশটির নাম হলো দিয়ারা। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাঞ্চলও নতুন পলিমাটি দ্বারা গঠিত হয়েছে এবং তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, সঙ্কোশ, বালাসোন, পুনর্ভবা, আত্রেয়ী ও অন্যান্য ছোট নদীগুলির জমা করা নুড়িপাথরে তৈরি হয়েছে এই অঞ্চল।
 
■ রাঢ় অঞ্চল:-

দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি ও উচ্চভূমি অঞ্চল ও গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের মাঝের অংশটিকে রাঢ় অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। মুর্শিদাবাদ জেলার অংশবিশেষ এবং গোটা বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে এই রাঢ় অঞ্চলটি । এই অঞ্চলটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৫০-১০০ মিটার। মনে করা হয়, দাক্ষিণাত্য মালভূমি থেকে আনীত মাটিতে এই অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে। ভাগীরথী-হুগলি নদীর উপনদী ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর ও রূপনারায়ণ নদ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই অঞ্চলের মাটি ল্যাটেরাইট প্রকৃতির। তাই এই মাটির রং লাল। এখানকার জমির স্বাভাবিক ঢাল পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।
 
■ উপকূলীয় সমভূমি:-

পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দক্ষিণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলে একটি ছোট উপকূলীয় সমভূমি দেখতে পাওয়া যায়। এই সমভূমি নদীপ্রবাহ ও বায়ুপ্রবাহের দ্বারা বাহিত বালি ও কাদায় গঠিত হয়েছে। উপকূল অঞ্চলের সমান্তরালে বালিয়াড়ি ও জলাভূমি দেখতে পাওয়া যায়। দিঘা বালিয়াড়ি বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে কাছে এবং কাঁথি বালিয়াড়ি সবচেয়ে দূরে অবস্থান করছে। কোথাও কোথাও সমুদ্র থেকে বালিয়াড়িগুলির দূরত্ব প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার এবং উচ্চতা প্রায় ১১-১২ মিটার।

■ পশ্চিমবঙ্গের বনভূমি:-

এই রাজ্যের ভৌগোলিক এলাকার মাত্র ১৪ শতাংশ বনভূমি দ্বারা সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রাজ্যের আয়তনের ৪ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকা। প্রাকৃতিক অবস্থার পার্থক্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের উদ্ভিদের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে রয়েছে লবণাক্ত ভূমি এখানেই আছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের একটি অংশ।

সুন্দরবন অঞ্চলের প্রধান গাছ হলো সুন্দরী। এছাড়া রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান অর্থকরী বৃক্ষটি হল শাল। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রধান বৃক্ষ হল ঝাউ। উত্তরবঙ্গের হিমালয়ের পাদদেশে ডুয়ার্স অঞ্চলে ঘন শাল ও অন্যান্য ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি লক্ষ্য করা যায়। সমুদ্রতল থেকে ১,৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত দার্জিলিঙে ওক, কনিফার, রডোডেনড্রন প্রভৃতি গাছ দেখতে পাওয়া যায়।

■ বন্য প্রাণী:-

বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য এই রাজ্যে মোট ৬টি জাতীয় উদ্যান গড়ে উঠেছে। এগুলো হলো‒সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প, গোরুমারা জাতীয় উদ্যান, নেওড়া উপত্যকা জাতীয় উদ্যান, সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান।

এই রাজ্যের সুন্দরবনে রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এই বনভূমিটি ভারতের বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত। বাঘ ছাড়াও সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায় বিভিন্ন প্রাণী যেমন- গাঙ্গেয় ডলফিন, নদী কচ্ছপ, মিষ্টি ও লবণাক্ত জলের কুমির, হরিণ, শুকর। এখানে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় মাছ দেখতে পাওয়া যায় সাগর এবং তৎসংলগ্ন নদীগুলোতে। রাজ্যের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে ভারতীয় গণ্ডার, ভারতীয় হাতি, হরিণ, বাইসন, চিতাবাঘ, গৌর ও কুমির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের মতো উচ্চ পার্বত্য বনভূমি অঞ্চলে বার্কিং ডিয়ার, রেড পান্ডা, চিঙ্কারা, টাকিন, সেরো, প্যাঙ্গোলিন, মিনিভেট, কালিজ ফেজান্ট প্রভৃতি বন্যপ্রাণী দেখা যায়। এই রাজ্যে জলাভূমিগুলিতে প্রচুর সংখ্যক পরিযায়ী পাখি শীতকালে আসতে দেখা যায়।