ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বর্ণনা | Fakirs and Monks Revolt

ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বর্ণনা | Fakirs and Monks Revolt

■ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হল ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ধনী রায়ত, জমিদার ও ইংরেজদের শোষণ থেকে বাংলা-বিহারের বিপর্যস্ত কৃষককুলকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্রধারণ করে ফকির ও সন্ন্যাসীরা নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে এটি ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে খ্যাত। তবে ইংরেজের হাত থেকে কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করার অভিপ্রায় এদের ছিল না। বিদ্রোহী সন্ন্যাসীরা ছিল জগৎগুরু শঙ্করাচার্যের অনুগামী ‘গিরি’ ও ‘পুরী’ সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দু।

অন্যদিকে ফকিররা ছিল মুসলিম। এরা প্রধানত সুফি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এদের নেতারা ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করত। হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতো এরাও গায়ে ছাই মাখত। শাহ মজনু বা মজনু শাহ, মুসা শাহ, চিরাগ আলি প্রমুখ ছিলেন জনপ্রিয় ফকির নেতা। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ-বিশারদ মজনু শাহের প্রতি সাধারণ মানুষের অসম্ভব সমর্থন ছিল।

শোনা যায়, তিনি নাকি জমিদারদের সম্পদ লুঠ করে সাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। ফকির ও সন্ন্যাসীরা দেশময় তীর্থে-তীর্থে, মেলায় – মেলায় ঘুরে বেড়াত। ফলে তারা ক্ষুধার্ত চাষি, সম্পদচ্যুত জমিদার, কর্মচ্যুত সৈনিকদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। এদের প্রথম প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘটে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা -য়। অচিরেই এই বিদ্রোহ দাবানলের মতো উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং চলে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে একদল ফকির ঢাকার ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে। কুঠির অধ্যক্ষ আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে ফকিরদের হাতে কুঠি তুলে দেন।

অন্যদিকে ওই বছরই সন্ন্যাসীরা রাজশাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়ার কুঠি লুঠ করে কুঠির অধ্যক্ষ বেনেটকে বন্দি করে নিয়ে যায়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রংপুরে সন্ন্যাসীরা এক যুদ্ধে সিপাহিদের পরাজিত করে। ওই সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন টমাস প্রাণ হারান। টমাসের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যিনি আসেন তিনিও সন্ন্যাসীদের হাতে প্রাণ হারান। এদিকে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুরে মজনু শাহের সঙ্গে সংঘর্ষে লেফটেন্যান্ট রবার্টসন -সহ আরও পঁচিশ জন সিপাহি আহত হন। ফকির-সন্ন্যাসীদের একটি বড়ো আশ্রয়স্থল ছিল উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকা। গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এই কৃষক বিদ্রোহটিকে ‘পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব’ বলে চিহ্নিত করে এদের দমন করার জন্য ভুটানের রাজার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

কিন্তু তাদের কার্যকলাপ বন্ধ করা যায়নি। ১৭৭৪ -এর ১৮ ই অক্টোবর হেস্টিংস ইংল্যান্ডে ডিরেক্টরদের জানালেন যে, ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধির ফলে প্রচণ্ড আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যাইহোক, উভয়ে কোম্পানির শত্রু হলেও ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে কোনো সদ্ভাব ছিল না। বিশেষ করে নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ফকিরদের প্রবল বিরোধ ছিল। তবে মজনু শাহের সঙ্গে সন্ন্যাসী-নায়ক ভবানী পাঠক -এর গভীর বন্ধুত্ব ছিল এর ব্যতিক্রম। ১৭৮৭ -র জুন মাসে রংপুরে ব্রিটিশ সৈন্যের এক আকস্মিক আক্রমণে কয়েকজন সঙ্গীসহ ভবানী পাঠক বীরের মৃত্যুবরণ করেন। ভবানী পাঠক ছাড়াও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের আর এক বিখ্যাত নেত্রী ছিলেন দেবী চৌধুরানী।

বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরানী উপন্যাস দুটিতে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সুন্দর বিবরণ আছে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের পর ফকির ও সন্ন্যাসীদের তৎপরতার কথা আর শোনা যায়নি। এইভাবে দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বহু চেষ্টার পর কোম্পানি এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। বিদ্রোহীদের ব্যর্থতার কারণ ছিল আধুনিক যুদ্ধকৌশলে অনভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব ও আদর্শের অভাব এবং সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ সংক্রান্ত দুর্বলতা। তাহলেও একথা বলা যেতে পারে যে, ইংরেজ শাসনের ফলে পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে গ্রাম-বাংলার মানুষ যে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বতঃস্ফূর্ত এই কৃষক বিদ্রোহটির গুরুত্ব এইখানেই।