ফারাজি আন্দোলনের বর্ণনা | Description of Faraji Movement

ফারাজি আন্দোলনের বর্ণনা | Description of Faraji Movement

■ উনিশ শতকে ফারাজি অভ্যুত্থান নামে একটি মুসলমান কৃষক বিদ্রোহ পূর্ব বাংলায় দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমাবনতি রোধ এবং হিন্দু জমিদার শ্রেণির কাছে মুসলমান কৃষক-কুলের বংশানুক্রমিক অধীনতা ও দুরবস্থার প্রতিকার করা। এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা হাজী শরিয়াতুল্লা বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমায় ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।

১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে আরবি সাহিত্য ও ইসলামীয় আইন সম্বন্ধে লেখাপড়ার জন্য তিনি মক্কা যান। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি মাদারিপুরে ফারাজি আন্দোলন গড়ে তোলেন। ‘ফারাজি’ শব্দটির উৎপত্তি আরবি ‘ফার্জ’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘ঈশ্বরের সেনানায়ক’। এর অনুগামীরা সকলেই ছিলেন সাধারণ কৃষক শ্রেণির নিম্নবংশজাত মুসলমান। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এরা হিন্দু জমিদারদের ব্যক্তিগত উৎসব ইত্যাদি পালনের জন্য অন্যায় অতিরিক্ত করসমূহের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। এইভাবে পূর্ববঙ্গের হিন্দু জমিদাররা এক ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।

এই আন্দোলন ব্যাপকতর রূপ পায় শরিয়াতুল্লার মৃত্যুর (১৮৩৭ খ্রিঃ) পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসীন আলাউদ্দিন আহম্মদ ওরফে দুদু মিঞা (১৮১৯-১৮৬২ খ্রিঃ) নেতৃত্ব গ্রহণ করলে। মিঞার নেতৃত্ব গ্রহণের সঙ্গে-সঙ্গে কৃষকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নই ফারাজি আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। পিতার মতো দুদু -ও তাঁর অনুগামীদের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ না করার জন্য উপদেশ দিতেন। কিন্তু পিতা অপেক্ষা পুত্রের চিন্তাধারা ছিল অনেক বেশি বাস্তব। কারণ দুদুর সমস্ত কিছু নির্দেশের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষক সমাজের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থার অবসান। তাই দুদুর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকসমাজ তাদের অর্থনৈতিক শোষক শ্রেণি অর্থাৎ জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। একদিকে যেমন তারা সরকারকে কর দেওয়া বন্ধ করে, অন্যদিকে তেমনি ব্রিটিশের আদালতে না গিয়ে গ্রামের বিবাদ গ্রামেই বিচার করার ব্যবস্থা করে।

কিন্তু যেহেতু কৃষকশ্রেণির অধিকাংশই ছিল মুসলমান এবং জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু, সেহেতু এই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংগ্রামটি দুর্ভাগ্যবশত শ্রেণি-সংগ্রামে পরিণত না হয়ে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শত্রুতায় পরিণত হয়।

যাইহোক, অচিরেই দুদু মিঞা এই আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামোকে পূর্ণ রূপ দেন। ইতিহাসে এটাই ফারাজি-খিলাফত্তন্ত্র নামে পরিচিত। এই সংগঠনে নিজস্ব লাঠিয়াল ও নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সেইসঙ্গে ফারাজি কার্যকলাপের উন্নয়ন প্রকল্পে একটি সাধারণ করও আদায় করা হত। এইভাবে ফারাজি আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এর ব্রিটিশ-বিরোধী ইসলামি চরিত্রটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ফলে পদস্য ইংরেজ কর্মচারীদের এই ধারণা হয় যে, ফারাজিদের ওই ব্রিটিশ সরকার তখন এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়। এদিকে এই আন্দোলন যেহেতু নিম্নশ্রেণির মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল, সেহেতু পূর্ববঙ্গের হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের যথেষ্ট ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ, ঢাকা, পাবনা, নোয়াখালি ও ত্রিপুরার হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে ফারাজিদের এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম শুরু হয়।

ফরিদপুরের এক প্রভাবশালী নীলকর সাহেব সেখানকার বিশিষ্ট হিন্দুদের সাহায্যে দুদুর প্রধান ঘাঁটি বাহাদুরপুর আক্রমণ করেন। প্রত্যুত্তরে ফারাজিরা নীলকুঠি আক্রমণ করে। এই ঘটনার পর ফারাজি-প্রভাব দ্রুত বিস্তারলাভ করতে থাকে এবং ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই দুদুর অনুগামীদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০,০০০। এই সময় থেকেই ব্রিটিশ সরকার ফারাজিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে এবং ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রধান প্রধান অনুচরসহ দুদু গ্রেপ্তার হন। তবে অল্পকালের মধ্যে তাঁরা ছাড়া পান। কিন্তু ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ শুরু হলে দুদুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১৮৬০ -এ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি অত্যন্ত পীড়িত হয়ে পড়েন এবং ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় পরলোকগমন করেন।

দুদুর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আবদুল গফুর ওরফে নোয়া মিঞা ফারাজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তবে নোয়া এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্যের ব্যাপারে পিতার অনুসৃত পথ থেকে সরে এসে পিতামহের পথেই ফারাজি আন্দোলনকে আবার বাঙালি মুসলমান সমাজের ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেন। ফলে ফারাজি আন্দোলন আরও কিছুকাল চললেও তার ঐক্যবদ্ধ কৃষক -আন্দোলনের চরিত্রটি হারিয়ে যায়।