আঞ্চলিকতাবাদের সংজ্ঞা ও উৎস | Definition and Sources of Regionalism

আঞ্চলিকতাবাদের সংজ্ঞা ও উৎস | Definition and Sources of Regionalism

(১) ■ আঞ্চলিকতাবাদের সংজ্ঞা (Definition and Sources of Regionalism):-

উত্তর:- টমাস হুয়েজলিন আঞ্চলিকতাবাদের পশ্চিমী ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এই রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর মতানুসারে উপজাতি বা জাতির অংশবিশেষ (Subnational) এবং অতিজাতি (transnational) -র মধ্যে পার্থক্যের অস্তিত্ব এবং স্বাতন্ত্র্য ও প্রতিশ্রুতির পার্থক্য আঞ্চলিকতা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। আবার আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য্যের উপর গুরুত্ব আরোপের জন্যও আঞ্চলিকতাবাদের ধারণা ব্যবহার করা হয়। আবার অনেকের অভিমত অনুসারে মাত্রাতিরিক্ত ও পীড়নমূলক এককেন্দ্রিকতার বিরোধী আন্দোলন আঞ্চলিকতাবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আঞ্চলিকতাবাদ হল একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির ভৌগোলিক এলাকার প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ এক ধরনের বিশেষ-আনুগত্য।

জাতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে অধিবাসীদের এক ধরনের সংযোগ-সম্পর্ক বা টান থাকে। এর থেকে স্বতন্ত্র আর এক ধরনের সংযোগ-সম্পর্ক বা আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় ভূখণ্ডের প্রশাসনিক বিভাজন বা প্রাদেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনুগত্য বা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এ রকম সংযোগ-সম্পর্ক বা আনুগত্য আঞ্চলিকতা হিসাবে প্রতীয়মান হয়। ডঃ নারাইনের অভিমত অনুসারে অন্যান্য দেশের মত ভারতের প্রেক্ষাপটেও আঞ্চলিকতাবাদ হল একটি অস্পষ্ট ধারণা। আঞ্চলিকতাবাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ব্যঞ্জনা বর্তমান। নেতিবাচক অর্থে আঞ্চলিকতাবাদের মাধ্যমে একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে একক আপেক্ষিক বঞ্চনার চেতনা বা মনোভাব জন্মায় এবং মনে করা হয় যে সরকারী কাজকর্মের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট বঞ্চনার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ইতিবাচক অর্থে একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের আত্মবিকাশের অনুসন্ধানই হল আঞ্চলিকতাবাদ।

(২) ■ আঞ্চলিকতাবাদের উৎস:-

উত্তর:- ভারতে আঞ্চলিকতাবাদের ইতিহাস খুবই পুরোনো। ব্রিটিশ আমলেও আঞ্চলিকতাবাদের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে আঞ্চললিকতাবাদের উৎসগুলি হল :

(ক) ভৌগোলিক আঞ্চলিকতাবাদ:- ভারতে প্রচুর ভৌগোলিক বিভিন্নতা বর্তমান। এক একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে এক একটি উপজাতির মানুষ বাস করে এবং তারা অন্য জনজাতির থেকে নিজেদের পৃথক ভাবে এবং আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখতে চায়।

(খ) অর্থনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদ:- ভারতের সব অঞ্চলে সমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে নি। এর ফলে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ নিজেদের শোষিত বা বঞ্চিত মনে করেছে। তারা ভেবেছে কেন্দ্রিয় সরকার বা জাতীয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন হবে না। ক্রমশই তারা জাতীয় রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুঁকছে, জন্ম হয়েছে আঞ্চলিকতাবাদের।

(গ) রাজনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদ:- কংগ্রেস দল থেকে বহু নেতা বেরিয়ে গিয়ে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে গিয়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। এইভাবেও আঞ্চলিকতাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। বর্তমানে এই দল পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং জাতীয় দলের মর্যাদা লাভ করেছে।

(ঘ) ভাষাগত আঞ্চলিকতাবাদ:- ভাষা একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে ভাষার প্রশ্নে প্রবল টানা-পোড়েন বর্তমান। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি হিন্দি ভাষার ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারে শঙ্কিত তাই এখানে হিন্দির অনুপ্রবেশ রোধ করতে ও নিজস্ব ভাষাকে রক্ষা করতে ভাষাগত আঞ্চলিকতাবাদের সৃষ্টি হয়েছে।

(ঙ) মনস্তাত্ত্বিক আঞ্চলিকতাবাদ:- আঞ্চলিকতাবাদ প্রধানত একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। মানুষের মনের গভীরে এর বীজ নিহিত থাকে। পাঞ্জাবের খালিস্তানি আন্দোলন, অসমের আন্দোলন, ঝাড়খণ্ড আন্দোলন প্রভৃতি সব আন্দোলনেই বস্তুগত উপাদান ছাড়াও মনস্তাত্ত্বিক উপাদান একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক কাশ্মীর আন্দোলনেও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের ভূমিকা সবচাইতে বেশি।