আইনের সংজ্ঞা ও উৎস, বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব | Definition and Sources of Law

আইনের সংজ্ঞা ও উৎস, বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব | Definition and Sources of Law

■ আইনের সংজ্ঞা (Definition and Sources of Law):-

উত্তর:: ব্যাপক অর্থে ‘আইন’ কথাটি বিভিন্নভাবে প্রযুক্ত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কিন্তু সংকীর্ণ অর্থে আইন কথাটি প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ এখানে কেবল রাষ্ট্রীয় আইন নিয়ে আলোচনা করা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। অস্টিনের মতে, ‘আইন হল সার্বভৌমের নির্দেশ (Law is the Command of the Sovereign)। তাঁর মতানুসারে আইন হল নির্দিষ্ট রাষ্ট্রনৈতিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রচিত রাষ্ট্রাধীন সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযুক্ত আদেশ।

হল্যাণ্ড -এর মতে, “সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই হল আইন।” আইন সম্পর্কে এই সংকীর্ণ ব্যাখ্যা আইনের বিশ্লেষণাত্মক ধারণা হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক দৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণের মতে, সার্বভৌম শক্তি কখনও সচল আইনের উৎস হতে পারে না। সমাজে বহু রীতিনীতি, লোকাচার প্রভৃতি প্রচলিত থাকে যা সাধারণভাবে আইনের ন্যায় মর্যাদা লাভ করে ও কার্যকরী হয়। কিন্তু এগুলিকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বা নির্দেশ বলা যায় না।

সুতরাং, আইন মাত্রেই সার্বভৌম শক্তির নির্দেশ নয়। উইল্‌সনের মতে, ‘আইন’ হল স্থায়ী আচার-ব্যবহার ও চিন্তাধারার সেই অংশ যা সাধারণ নিয়মাবলী হিসাবে সুস্পষ্ট এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং যার পিছনে সরকারের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বর্তমান’। উইল্সনের মতকে সমর্থন করে অধ্যাপক গেটেল -ও বলেছেন যে, যে সকল নিয়ম রাষ্ট্র সৃষ্টি, স্বীকার ও বলবৎ করে সেগুলিই আইনে পরিণত হয়। বার্কার -এর মতানুসারে আদর্শ আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য উভয় থাকা দরকার। আইনের পিছনে সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সমর্থনকে বৈধতা বলে। আর নৈতিক মূল্য হল এই যে, আইন সামাজিক ন্যায় নীতিবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে বার্কার স্বীকার করেছেন যে, আইন বৈধ হলেই সকলে তা মানতে বাধ্য, সেই আইনের নৈতিক মূল্য থাক বা না থাক।

■ আইনের উৎস:-

উত্তর:: আইন সার্বভৌমের আদেশ অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে রাষ্ট্রকে আইনের উৎস বলে মনে হলেও আইন একাধিক উৎস জাত। আদিম সভ্যতা থেকেই নানা সূত্র থেকে আইনের সৃষ্টি হয়।

হল্যাণ্ডের মতে উৎসগুলি হল প্রথা, ধর্ম, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা, ন্যায় বিচার এবং আইন প্রণয়ন। আইনের প্রাচীন উৎস প্রথা, লোকাচার কালক্রমে যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে আইনে পরিণত হয়। প্রথার পাশাপাশি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, অনুশাসন ও আইনের উৎস হিসাবে বিবেচিত। দ্বন্দ্ব মীমাংসাকারী গোষ্ঠিপতি বা পরবর্তীকালে বিচারপতিরা যে সিদ্ধান্ত দান করেন তাও আইনের উৎস। তাঁদের ব্যক্তিগত ন্যায়নীতির ধারণাও অন্যতম উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষজ্ঞরা আইন সম্পর্কে নানা মতামত সিদ্ধান্ত দেন। তাঁদের ভাষ্য, ব্যাখ্যা বিচারকার্যে প্রয়োগ করা হয় এবং আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বর্তমান যুগে বিধি নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে আইন প্রণয়নকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। আইনসভা এর উৎস। জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বিপুল দায়িত্ব পালনের জন্য একাধিক আইন সৃষ্টি করে। জনগণের প্রতিনিধিপুষ্ট আইনসভা যে আইন প্রণয়ন করে তা জনমতেরই বিধিবদ্ধ রূপ।

■ আইন সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব:-

উত্তর:: ইংরেজ আইনবিদ অস্টিনের ভাষায়, “আইন হল সার্বভৌমের নিদের্শ।” তাঁর মতে আইন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রনৈতিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রচিত রাষ্ট্রাধীন সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযুক্ত আদেশ। সার্বভৌমের আদেশ হিসাবে আইন বাধ্যতামূলকভাবে বলবৎ হয়। ইংরেজ আইনবিদ্ অস্টিন আইনের বিশ্লেষণাত্মক ধারণার মুখ্য প্রবক্তা। আধুনিককালের সমর্থকদের মধ্যে ইংল্যান্ডের হল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলোবির নাম উল্লেখযোগ্য।

তা ছাড়া বোঁদা, হস, বেন্থামও বিশ্লেষণমূলক মতবাদের সমর্থক হিসাবে পরিচিত। -এই মতবাদ ‘আদেশতত্ত্ব’ (Command Theory) হিসেবেও পরিচিত। কারণ সার্বভৌমের আদেশ বলে আইন বলবৎ হয় এবং নাগরিকেরা একে মানতে বাধ্য। হল্যাও মন্তব্য করেছেন সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই হ’ল আইন। বিশ্লেষণমূলক মতবাদের সূচনা হবসের রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে। এই তত্ত্বের সঙ্গে নাগরিক শৃঙ্খলা, সংযত নাগরিক সুশীল সমাজ গড়ে তোলার বিষয়টি যুক্ত।