পশ্চিমবঙ্গের সাপেক্ষে রাজ্য আইনসভার গঠন ও কার্যাবলী | Constitution and Functions of State Legislatures

■ প্রশ্ন:- পশ্চিমবঙ্গের সাপেক্ষে রাজ্য আইনসভার গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা কর (Constitution and Functions of State Legislatures)।

উত্তর:- ■ বিধানসভার গঠন: রাজ্য আইনসভার জনপ্রতিনিধি কক্ষ হল বিধানসভা। বিধানসভার গঠন সম্পর্কে সংবিধানের ১৭০ ধারায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধান অনুসারে কোন অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার সদস্যসংখ্যা ৬০ -এর কম বা ৫০০ -এর বেশী হবে না। রাজ্য বিধানসভার সদস্যসংখ্যা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জনগণনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার মোট নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা ২৯৪। তা ছাড়া রাজ্যপাল কর্তৃক মনোনীত ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের ১ জন প্রতিনিধি থাকেন। তখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৫।

■ প্রত্যক্ষ নির্বাচন:- বিধানসভার সদস্যগণ সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে রাজ্যের নাগরিকদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের জন্য সমগ্র রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে কতকগুলি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হয়। প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন করে সদস্য নির্বাচিত হন। সাধারণতঃ প্রতি ৭৫ হাজার জনসংখ্যাপিছু একজন সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

■ রাজ্যপালের মনোনয়ন:- তা ছাড়া রাজ্যপাল যদি মনে করেন যে রাজ্যের বিধানসভায় ইঙ্গ-ভারতীয় (Anglo-Indian) সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব যথাযথ হয় নি, তা হলে তিনি ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে একজন সদস্য মনোনীত করতে পারেন (৩৩৩ ধারা)।

■ সদস্য পদপ্রার্থীর যোগ্যতা:- বিধানসভার সদস্যপদ প্রার্থীর নিম্নলিখিত যোগ্যতাসমূহ থাকতে হয়। (ক) তাঁকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে; (খ) তাঁর বয়স হবে অন্তত পঁচিশ বছর; (গ) কোন সরকারি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা চলবে না। তেমন কোন পদে অধিষ্ঠিত থাকলে প্রার্থী হবার আগে তা ছাড়তে হবে; (ঘ) আদালত কর্তৃক দেউলিয়া বা বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন বলে ঘোষিত কোন ব্যক্তি সদস্যপদের প্রার্থী হতে পারবেন না; (ঙ) কোন ব্যক্তি একসঙ্গে বিধানসভা ও পার্লামেন্টের সদস্য থাকতে পারেন না। সংসদ ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের পরিচয় সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

■ স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার:- বিধানসভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে অধ্যক্ষ বা স্পীকার (Speaker) এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ বা ডেপুটি স্পীকার (Deputy Speaker) হিসাবে নির্বাচিত করেন। স্পীকার সভার সদস্যদের ভিতর থেকে অনধিক ছ’জনকে সভাপতি (Chairman) হিসাবে মনোনীত করেন। স্পীকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পীকার সভার কাজকর্ম পরিচালনা করেন। এবং এই দুই পদাধিকারীর অনুপস্থিতিতে সভাপতিগণ পরামর্শ অনুযায়ী সভার কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন রাজ্য আইনসভাগুলি রাজ্যের জন্য আইন প্রণয়ন ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু ও বিবিধ কার্য সম্পাদন করে।

■ আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা:-

● রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন: রাজ্য আইনসভার প্রধান কাজ হল রাজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা। রাজ্য আইনসভা সমগ্র রাজ্য বা রাজ্যের যে-কোন অংশের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে। রাজ্য তালিকার (State List) অন্তর্ভুক্ত সকল বিষয়ে রাজ্য আইনসভার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা বর্তমান। সাধারণভাবে রাজ্য আইনসভার এই ক্ষমতা অনন্য। কিন্তু জরুরী অবস্থায় এবং সংবিধান অনুসারে অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজ্যতালিকাভুক্ত বিষয়ে পার্লামেন্টও আইন প্রণয়ন করতে পারে। রাজ্যপালের সম্মতিঃ রাজ্য আইনসভায় পাস হওয়া প্রতিটি বিলে রাজ্যপালের স্বাক্ষর অপরিহার্য। রাজ্যপাল বিলে সম্মতি দিতে পারেন; দিলে তা আইনে পরিণত হয়। তিনি অসম্মতিও জ্ঞাপন করতে পারেন, সেক্ষেত্রে বিলটি বতিল হয়ে যায়। আবার রাজ্যপাল কোন বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন।

● যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইনপ্রণয়ন: যুগ্ম তালিকার (Concurrent List) অন্তর্ভুক্ত বিষয়েও রাজ্য আইনসভা আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে পার্লামেন্ট প্রণীত আইনই প্রাধান্য পায়।

■ (২) শাসন-বিভাগ গঠন ও নিয়ন্ত্রণ:-

● মন্ত্রিসভা গঠন: বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাই রাজ্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তবে বিধানসভার সদস্য না হয়েও রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়া যায়। বিধানপরিষদ থেকেও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগ করতে পারেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণত বিধানসভার সদস্য হন। বস্তুত রাজ্যের মন্ত্রিসভার গঠন বিধানসভার উপর নির্ভরশীল, কারণ যে রাজনৈতিক দল বা জোট বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল বা গোষ্ঠী মন্ত্রিসভা গঠন করে।

● শাসন-বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ: রাজ্যের শাসন-বিভাগকে বিধানসভার কাছেই দায়িত্বশীল থাকতে হয়। রাজ্যের মন্ত্রিসভার কার্যকালের মেয়াদ বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিধানসভায় কোন অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। অর্থাৎ মন্ত্রিসভাকে বিধানসভার অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন থাকতে হয়।

● নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা : শাসন-বিভাগের উপর বিধানসভার এই নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে তাত্ত্বিক, বড় একটা বাস্তব নয়। কারণ এখন দলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। নির্বাচনের পর বিধানসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতৃবর্গই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই কারণে মন্ত্রিসভা সহজেই বিধানসভার আস্থাভাজন থাকে। বিধানসভায় মন্ত্রিসভার পরাজয়ের আশংকা থাকে না বললেই হয়। আবার মন্ত্রীরা হলেন বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এই নেতাদের কথা মেনে চলতে বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা বাধ্য থাকেন।

● মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা : তবে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতের রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। তাই এখন বিধানসভার কাছে মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা একটা রূঢ় ও কঠিন সত্য হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

■ (৩) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা (Financial Powers):

রাজ্য সরকারের কর ধার্য, কর সংগ্রহ ও ব্যয়-বরাদ্দের ক্ষমতা বিধানসভা নিয়ন্ত্রণ করে। বিধানসভার অনুমোদন ছাড়া রাজ্য সরকার কর ধার্য, কর সংগ্রহ বা অর্থ ব্যয় করতে পারে না। বাজেট, রাজস্ব বিল, বিনিয়োগ বিল প্রভৃতি প্রথমে বিধানসভাতেই উত্থাপন করতে হয়। বিধানসভা অনুমোদন না করলে সরকারের ব্যয় মঞ্জুরীর দাবি কার্যকর করা যায় না। বিধানসভা সরকারের ব্যয়-মঞ্জুরীর দাবী প্রত্যাখ্যান বা হ্রাস করতে পারে, কিন্তু ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে না।

■ (8) সংবিধান সংশোধন:-

ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের মূল ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় স্বার্থ সম্পর্কিত কতকগুলি বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য অন্ততঃ অর্ধেক রাজ্য আইনসভার অনুমোদন লাগে [৩৬৮ (২) ধারা]। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্ট সম্পর্কিত বিষয় প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

■ (৫) অন্যান্য ক্ষমতা:- (ক) বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ ও তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বিধানসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। বিধানসভার সদস্যগণ সরকারী কার্যকলাপ ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মন্ত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। মন্ত্রীদের এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। বিধানসভায় এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় মন্ত্রী যে সমস্ত সংবাদ ও তথ্য পেশ করেন তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংগৃহীত হয়ে থাকে। বেতার, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণ-মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণ এই সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। (খ) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য একটি বিশেষ নির্বাচক সংস্থা (Electoral College) গঠন করা হয়। রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা এই সংস্থার সদস্য হিসাবে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। (গ) বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা সংশ্লিষ্ট রাজ্য থেকে রাজ্যসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন।