ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বর্ণনা | Colonial Rule During the British Period

ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বর্ণনা | Colonial Rule During the British Period

ব্রিটিশের এই ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো তার প্রাথমিক রূপ পায় বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭৪-৮৫ খ্রিঃ) ও তাঁর পরবর্তী গভর্নর-জেনারেল কর্নওয়ালিসের আমলে (১৭৮৬-৯৩ খ্রিঃ)। প্রধানত চারটি স্তম্ভের উপর এই শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল— সিভিল সার্ভিস, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা।

■ সিভিল সার্ভিস:- গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস এদেশে সিভিল সার্ভিসের পত্তন করেন। এটি প্রশাসনিক শ্রেণির এক ধরনের পদ। কোম্পানির শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করতে এই পদের সৃষ্টি। এই শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ছিল ঈর্ষণীয়। একজন জেলা কালেক্টরের মাসিক বেতন ধার্য হয়েছিল ১৫০০ টাকা । সেই সঙ্গে এই সার্ভিসে চাকুরির দৈর্ঘ্য হিসাবে পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকবে বলে কর্নওয়ালিস নিয়ম করেন।

গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি এই সার্ভিসে সদ্য নিযুক্ত তরুণদের উপযুক্ত শিক্ষাদানের জন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। পরে ব্রিটেনের হেইলবেরিতে ওই একই উদ্দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ নামে একটি কলেজ খোলা হলে কলকাতার কলেজটি বন্ধ করে দেওয়া হয় (১৮০৬ খ্রিঃ)। নতুন কলেজটি ‘হেইলবেরি কলেজ’ নামেও পরিচিত।

উল্লেখযোগ্য যে, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট অনুসারে এই সার্ভিসে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা-মূলক পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়; ফলে কোম্পানির পরিচালকরা এই ব্যাপারে প্রার্থী নিয়োগের এত দিনের অধিকার হারায়। তবে শুরু থেকেই এই চাকুরিতে ভারতীয়দের নিয়োগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ছিল একটি সুদক্ষ ও ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠী। এদের হাতে যেমন প্রচুর ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল, তেমনি শাসনতান্ত্রিক নীতি নির্ধারণের অধিকারও দেওয়া হয়েছিল। তাই ভারতীয় সিভিল সার্ভিসকে কেউ-কেউ এদেশে ব্রিটিশ শাসনের ধারক ও বাহক রূপে বর্ণনা করেছেন।

■ সামরিক বাহিনী : ভারতে ব্রিটিশ শাসনের দ্বিতীয় স্তম্ভটি ছিল তার সেনাবাহিনী। ১৭৫৭ খ্রিঃ থেকে ১৮৫৭ খ্রিঃ–এই একশ বছরের মধ্যে এদের সাহায্যেই কোম্পানি তার ভারত-বিজয় সম্পন্ন করেছিল। দেশীয় রাজ্য দখল করা; অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে কোম্পানির প্রভুত্ব বজায় রাখা এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ করা —এই তিনটি ছিল তাদের প্রধান কাজ। কোম্পানির সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সেনাই ছিল ভারতীয়। এরা সিপাহি নামে পরিচিত ছিল।

একটি হিসাবে দেখা যায়, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে এদেশে কোম্পানির মোট সৈন্য সংখ্যা যেখানে ছিল ৩,১১,৪০০, সেখানে ২,৬৫,৯০০ জনই ছিল ভারতীয়। কর্নওয়ালিসের আমল থেকেই কোনো উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হত না। তাদের পক্ষে উচ্চতম পদ ছিল সুবেদার। তবে এদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। এইসব সৈন্য প্রধানত বর্তমান বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে সংগ্রহ করা হত। ঐতিহাসিক স্পিয়ার বলেছেন, “যদি সিভিল সার্ভিস গভর্নর জেনারেলের ডান হাত হয়, সেনাবাহিনী ছিল তার বাম হাত”।

■ পুলিশ:- ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তৃতীয় স্তম্ভটি ছিল পুলিশ বিভাগ। অধিকৃত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং এদেশে ব্রিটিশ শাসনকে স্থায়ী করতে এই পুলিশি ব্যবস্থা অনেকখানি সাহায্য করেছিল। আগে পুলিশি দায়িত্ব ছিল বিকেন্দ্রীকৃতভাবে জমিদারদের হাতে। কর্নওয়ালিস জমিদারদের ওই দায়িত্ব পালন করা থেকে মুক্তি দিয়ে এই ব্যবস্থাকে প্রথম এক সুস্পষ্ট রূপ দেন। তিনিই ছিলেন ভারতে পুলিশি-ব্যবস্থার স্রষ্টা। এক-একটি জমিদারি এলাকা নিয়ে একটি করে থানা সৃষ্টি করে তিনি ওই এলাকার শান্তি রক্ষার জন্য দারোগা পদ সৃষ্টি করেন। জেলার পুলিশি ব্যবস্থা তিনি জেলা শাসকের অধীনে স্থাপন করেন।

উল্লেখ্য, কর্নওয়ালিস বাংলাকে মোট ২৩ টি জেলায় বিভক্ত করেন। স্থির হয়, গ্রামগুলিতে পুলিশের দায়িত্ব পালন করবে গ্রামের চৌকিদার, যার ভরণপোষণের ভার নেবে গ্রামবাসীরাই। আর কলকাতার শান্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে একজন পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ও তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা। পরবর্তীকালে অবশ্য জেলা পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট পদ সৃষ্টি করে তাঁর উপর জেলার পুলিশি ব্যবস্থার দায়িত্ব অর্পিত হয়। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য — ইংল্যান্ডের এই ঐতিহ্য অনুসরণ করেই কর্নওয়ালিস এমন একটি পুলিশি ব্যবস্থা এদেশে রচনা করেন যা সমসাময়িক ইংলন্ডেও গড়ে ওঠেনি। তবে এই বিভাগের উচ্চতর সমস্ত পদ ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

■ বিচার ব্যবস্থা:- ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে কায়েম করতে ব্রিটিশ এদেশে এক নতুন ধরনের বিচারব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। প্রশাসনিক কাঠামোর এই চতুর্থ স্তম্ভটি সূচনা করেন ওয়ারেন হেস্টিংস। এই ব্যবস্থা দ্বারা পৃথক-পৃথক ভাবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত সংগঠিত করা হয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার আপিল শুনানির জন্য দুটি সর্বোচ্চ আদালত — সদর দেওয়ানি ও সদর নিজামত আদালত যথাক্রমে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রথমটিতে সপার্ষদ গভর্নর-জেনারেল ও দ্বিতীয়টিতে স্বয়ং নবাব ছিলেন বিচারক। তবে হেস্টিংস-প্রবর্তিত বিচারব্যবস্থার বেশ কিছু সংস্কার করেছিলেন কর্নওয়ালিস। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিস কোড -এর মাধ্যমে তিনি ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করে তোলেন। এইভাবে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হল ‘আইনের শাসন’ (Rule of Law)। এর অর্থ কোনো মানুষই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।