ফ্যাসীবাদের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি | Characteristics of Fascism

ফ্যাসীবাদের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি | Characteristics of Fascism

■ প্রশ্ন:- ফ্যাসীবাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো। (Characteristics of Fascism).

■ উওর:- ফ্যাসীবাদী একনায়কতন্ত্রের স্বরূপ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

❏ (১) সমাজতন্ত্রের বিরোধী:- ফ্যাসীবাদ রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দর্শনকে সমর্থন করে না। হেগেলীয় আদর্শবাদের ভিত্তিতে ফ্যাসীবাদ পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রের এই সর্বময় কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের অধিনায়কের মাধ্যমে কার্যকরী হয় এবং তাঁর নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

❏ (২) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী:- ফ্যাসীবাদ আবার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরও বিরোধী। এ রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বে বিশ্বাসী। ব্যক্তিজীবনের সবকিছুই সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে সম্পাদিত হয়।

❏ (৩) যুদ্ধবাদ মতবাদ:- ফ্যাসীবাদ শান্তিবাদেও বিশ্বাসী নয়। ফ্যাসীবাদ শান্তির ধারণাকে ভীরুতা বলে অবজ্ঞা করে। এ যুদ্ধবাদকে স্বাভাবিক এবং সাম্রাজ্যবাদকে শাশ্বত নিয়ম হিসাবে স্বীকার করে।

❏ (৪) গণতন্ত্রবিরোধী ও অভিজাততান্ত্রিক:- স্বাভাবিক কারণে ফ্যাসীবাদ গণতন্ত্রের আদর্শকেও অস্বীকার করে। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয়। সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করা হয়। ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রে নেতৃপূজা বা বীরপূজা পরিলক্ষিত হয়।

❏ (৫) জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উপর প্রাধান্য:- ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী প্রভৃতিকে উপেক্ষা করা হয় এবং ফ্যাসীবাদী নিয়মনীতি, কর্তব্য, নিষ্ঠা প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ব্যক্তির স্বাধীনতার জন্য রাষ্ট্রশক্তি ও আইনের প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়। এখানে সুগঠিত ও সুসংহত জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উপর বিশেষ প্রাধান্য আরোপ করা হয়ে থাকে।

❏ (৬) অর্থনৈতিক নীতি:- ফ্যাসীবাদী ব্যবস্থার অর্থনৈতিক বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা রাষ্ট্র-কর্তৃত্ববাদ কোনটিকেই সমর্থন করা হয় না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এখানে স্বীকৃত। কিন্তু এই অধিকার সব সময় জাতীয় স্বার্থের অধীন।

❏ (৭) যৌথ রাষ্ট্রের ধারণা:- ফ্যাসীবাদী ব্যবস্থায় যৌথ রাষ্ট্রের (Corporate) ধারণা প্রচার করা হয়। ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্য সকল রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করা হয় এবং কেবলমাত্র ফ্যাসিস্ট দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় এবং প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসীবাদ সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থায় আস্থাশীল।

❏ (৮) রাজনৈতিক মতবাদ নয়:- ফ্যাসীবাদ কোন বিশেষ রাজনৈতিক দর্শন বা মতাদর্শ হিসাবে গণ্য হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে ফ্যাসীবাদ হল একটি বিশেষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী। সমালোচনাঃ বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক ধিকৃত স্বৈরতান্ত্রিক আন্দোলন হল এই ফ্যাসীবাদ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফ্যাসীবাদী একনায়কতন্ত্র এক বিভীষিকাস্বরূপ।

● (ক) সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক:- ফ্যাসীবাদী বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক। জনগণের সার্বভৌমত্ব ফ্যাসীবাদে অস্বীকৃত। এখানে রাষ্ট্র হল সর্বশক্তিমান, চরম ও অভ্রান্ত। ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতা বাছাই করা কিছু ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। ফ্যাসিস্ট দল ছাড়া অন্য সকল রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে বলপূর্বক ধ্বংস করা হয়। সব রকম বিরোধিতা ও সমালোচনাকে। সন্ত্রাসমূলক পথে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।

● (খ) ব্যক্তি-স্বাধীনতার ধারণা ভ্রান্ত:- ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্পর্কে ফ্যাসীবাদী ধারণা ভ্রান্ত। স্বাধীনতার উপলব্ধির জন্য রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও স্বার্থের কাছে ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেই ব্যক্তি তাঁর স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।

● (গ) সাম্রাজ্যবাদী মতবাদ:- ফ্যাসীবাদ যুদ্ধবাজ ও সাম্রাজ্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। ফ্যাসীবাদে উগ্রজাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করা হয়। সুতরাং ফ্যাসীবাদ হল আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও মৈত্রীর আদর্শের বিরোধী এবং মানবসভ্যতার শত্রু।

● (ঘ) সাম্যবিরোধী:- ফ্যাসীবাদ সাম্যের আদর্শের বিরোধী। রাজনৈতিক সাম্য এবং জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাম্য এখানে অস্বীকৃত।

● (ঙ) প্রচলিত মূল্যবোধকে অস্বীকার:- ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রে একনায়ক তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মিথ্যাপ্রচার, বাগাড়ম্বর, প্রতারণা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। তা ছাড়া প্রচলিত যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা ও ধ্বংস করা হয়।

● (চ) ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্র হল সর্বাত্মক রাষ্ট্র । জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর সর্বব্যাপক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত। এর ফলে শিক্ষা-সংস্কৃতি; শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষের জীবনধারার স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ হয়।

● (ছ) মার্কসবাদীদের মতানুসারে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থের অনুকূলে এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে ফ্যাসীবাদী স্বৈরতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত হয়।

■ উপসংহার:- বস্তুতপক্ষে, ফ্যাসীবাদ এক নিকৃষ্ট ধরনের একনায়কতন্ত্র ব্যতীত কিছুই নয়। ফ্যাসীবাদ ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী; সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সংগঠন ও ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধবাদকে ফ্যাসীবাদ প্রশ্রয় দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদকে আহ্বান জানায়। এই তত্ত্ব মানবতা বিরোধী এবং বিশ্বশান্তির শত্রু। মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবর্তে ফ্যাসীবাদ দ্বন্দ্ব, কলহ ও সংকটকে স্বাগত জানায়। প্রকৃত বিচারে ফ্যাসীবাদকে কোন দার্শনিক তত্ত্বের মর্যাদা দেওয়া যায় না। এর পিছনে কোন ভাবাদর্শ নেই। তাই মুসোলিনীর পতনের পর ইতালীতে ফ্যাসীবাদের পতন হতে বিলম্ব হয় নি। আবার উগাণ্ডায় ইদি আমিন নিজেই নিজের ফ্যাসীবাদের পতন চাক্ষুস করেছেন। বস্তুতঃ ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুসারে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির কাছে ফ্যাসীবাদী দানব বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য। স্পেন, চীন, জাপান ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ইতিহাস এই সত্যকে প্রমাণ করেছে।