অরণ্যচ্ছেদনের কারণ ও প্রভাব (The great 10 Causes and effects of deforestation)

অরণ্যচ্ছেদনের কারণ ও প্রভাব (Causes and effects of deforestation) :

কোনাে একটি বনাঞ্চলে বনসৃজন ছাড়াই বৃক্ষদেনের মাধ্যমে বনভূমির ধ্বংসসাধন বা অরণ্যের বিনাশকে অরণ্যচ্ছেদন বলে। অরণ্যচ্ছেদনের প্রধান কারণ গুলি হলঃ

(১) কাষ্ঠ আহরণঃ সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত কাঠের চাহিদা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। জ্বালানি, গৃহনির্মাণ, আসবাবপত্র নির্মাণ, কাঠের সেতু নির্মাণ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, জাহাজ, নৌকা, কাগজ শিল্পে কাঠের চাহিদা থাকায় বন্যফল থেকে অরণ্যচ্ছেদনের মাধ্যমে কাঠ সংগৃহীত হয়।

( ২ ) কৃষিক্ষেত্রের আয়তন বৃদ্ধিঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে খাদ্যশস্যের জোগানকে সুনিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অরণ্যচ্ছেদনের মাধ্যমে কৃষিজমি তৈরি করা হয়েছে।

( ৩ ) স্থানান্তর কৃষিঃ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত কৃষিপদ্ধতি স্থানান্তর কৃষি বা জুম চাষ নামে প্রসিদ্ধ। স্থানান্তর কৃষিপদ্ধতিতে কৃষিজমির প্রধান উৎস হল বনাঞ্চল। এই ধরনের কৃষিপদ্ধতিতে অরণ্যের গাছপালা পুড়িয়ে কৃষিক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। একটি সমীক্ষার হিসেব অনুযায়ী ভারতে ৪৩ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর জমি স্থানান্তর কৃষিপদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

( ৪ ) পশুচারণঃ কোনাে অঞ্চলে পশুচারণ ক্ষেত্রের আয়তন বৃদ্ধি পেলে বনভূমির আয়তন হ্রাস পায়। ভারতের উত্তরালে অনিয়ন্ত্রিত পশচারণের ফলে বনভূমির আয়তন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

( ৫ ) নগর ও শিল্পের বিকাশঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অরণ্যচ্ছেদনের মাধ্যমে নগরাণ ও শিল্পায়নের বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হয়েছে।

( ৬ ) খনিজ সম্পদ আহরণঃ ধাতব খনিজ দ্রব্য যেমন – আকরিক লােহা, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, সিসা এবং ধাতব খনিজ যেমন কালা, খনিজ তেল, অভ্র প্রভৃতি উত্তোলনের জন্য অরণ্যচ্ছদানের মাধ্যমে খনি ( mines ) খনন করা হয়।

( ৭ ) বহুমুখী নদীপরিকল্পনাঃ বহুমুখী নদীপরিকল্পনায় জলের জোগানকে সুনিশ্চিত করার জন্য বাধের পেছনের অংশে গাছপালা কেটে জলাধার তৈরি করা হয়।

( ৮ ) সড়কপথ নির্মাণঃ সমভূমি অখুলে সড়ক নির্মাণের জন্য অরণ্যচ্ছেদনের পরিমাণ কম হলেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে অরণ্যচ্ছেদনের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণ করা হয়।

( ৯ ) দাবানলঃ গাছের ডালপালায় ক্রমাগত ঘর্ষণ, বজ্রপাত কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে দাবানল সৃষ্টি হলে বনভূমির পরিমাণ হ্রাস পায়।

( ১০ ) অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অরণ্যচ্ছেদনঃ মানুষ নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিণত বৃক্ষ, অপরিণত বৃক্ষ নির্বিশেষে ধ্বংস করে চলেছে।

অরন্যছেদনের প্রভাব (Effect of deforestation) :

( ১ ) মৃত্তিকা ক্ষয়ঃ অরণ্যছেদনের ফলে মৃত্তিকা কণাগুলি আলগা হয়ে যায় এবং বৃষ্টির জলে অতিসহজেই তা ক্ষয় পেয়ে অন্য জায়গায়। নান্তরিত হয়।

( ২ ) কৃষি উৎপাদন হ্রাসঃ অরণ্যচ্ছেদনজনিত কারণে মৃত্তিকার উপরিস্তর ক্ষয় পেলে মৃত্তিকার উর্বরতা শক্তি কমে যায়। এর ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়।

( ৩ ) নদীর গভীরতা হ্রাসঃ অরণ্যচ্ছেদন জনিত কারণে মৃত্তিকা স্তর ক্ষয় পায় এবং নদীখাতে সঞ্চিত হলে নদীর গভীরতা কমে যায়। ফলে নদীতে প্লাবন বা বন্যা দেখা যায়।

( ৪ ) বৃষ্টির পরিমাণ হ্রাসঃ বনাঞ্চল বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প সরবরাহ করে ফলে সেই সরবরাহ ব্যাহত হলে বৃষ্টির পরিমাণ হ্রাস পায়।

( ৫ ) বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধিঃ অরণ্যচ্ছেদনের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যার ফলস্বরূপ বিশ্বজুড়ে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

( ৬ )মরুভূমির প্রসার বৃদ্ধিঃ অরণ্যচ্ছেদনের ফলে বনভূমির আয়তন ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকায় অদূর ভবিষ্যতে মরুভূমির প্রসারকে কোনাে মতে রােধ করা যাবে না।

( ৭ ) জলচক্রের ভারসাম্য নষ্টঃ অরণ্যচ্ছেদনজনিত কারণে জলচক্রের পর্যায়ক্রমিক আবর্তন অর্থাৎ বায়ুমণ্ডল থেকে বারিমণ্ডল এবং বারিমণ্ডল থেকে বায়ুমণ্ডলে জলের জোগান ব্যাহত হয়।

( ৮ ) পশুপাখির আশ্রয়স্থলের অভাবঃ বনভূমি হল বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির আশ্রয়স্থল। যথেচ্ছভাবে অরণ্যনিধনের ফলে বনাশুলের বাস্তৃতান্ত্রিক নিয়মতন্ত্র বিনষ্ট হয়।

( ৯ ) প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিঃ অরণ্যচ্ছেদনের ফলে খরা, বন্যা, ভূমিধস, সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

( ১০ ) পরিবেশের অক্ষয়ঃ পরিশেষে বলা যায়, যথেচ্ছভাৱে অরণ্যচ্ছেদনের ফলে একদিকে যেমন মরুভূমির প্রসার বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি, মৃত্তিকাক্ষয় বৃদ্ধি পেতে থাকে, অন্যদিকে তেমনি অরণ্যের বাস্তৃতন্ত্রের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, জলচক্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়। সামগ্রিকভাবে পরিবেশের চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়।

Leave a comment