মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ | Cause of Fall of Mauryan Empire

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ | Cause of Fall of Mauryan Empire

■ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, চাণক্য ও অশোকের প্রচেষ্টায় মৌর্য সাম্রাজ্য এক বিশাল রূপ ধারণ করলেও খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩ অব্দে অশোকের মৃত্যুর পর খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দের মধ্যে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সেই সুযোগ নিয়ে দশম সম্রাট বৃহদ্রথকে তার সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হত্যা করে সিংহাসন দখল করে নেয়। তবে কোনো একটি বিশেষ কারণের জন্য মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ছিল এ কথা বলা যায় না। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে দায়ী ছিল একাধিক কারণ। এগুলি হল-

■ ব্রাম্মন সম্প্রদায়ের বিরোধিতা:-

পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মনে করতেন, অশোকের প্রতি ব্রাম্মণদের বিদ্বেষ ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের এক অন্যতম কারণ। তিনি মনে করেন –

১. পশুবলি সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাই ছিল একমাত্র ব্রাম্মণদের বিদ্বেষের কারণ।

২. দন্ড সমতা ও ব্যবহার সমতা নীতির প্রবর্তন করে অশোক ব্রাম্মণদের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করায় ব্রাম্মণদের মধ্যে বিদ্বেষ জন্ম নেয়।

৩. ধর্মমহামাত্র নিয়োগ করে অশোক ব্রাম্মণদের একছত্র অধিকারে হস্তক্ষেপ করে ব্রাম্মণদের বিদ্বেষের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।

এই সমস্ত কারণে ব্রাম্মনরা পুষ্যমিত্র শুঙ্গের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মৌর্য বংশের বিলোপ সাধনে সহায়তা করেছিল।

■ সাম্রাজ্যের বিশালতা:-

মৌর্য সাম্রাজ্যের আয়তনের বিশালতা তার পতনের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে যুগে দ্রুত গমনাগমন ব্যবস্থার অভাবে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় কেন্দ্রীয় রাজশক্তির পক্ষে সর্বত্র আধিপত্য বজায় রাখা অসম্ভব ছিল। 

■ প্রশাসনিক দুর্বলতা:-

রাজনৈতিক দিক দিয়ে মৌর্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুগঠিত হওয়ার স্বত্তেও এর কতকগুলি দুর্বলতাও ছিল। এর আমলাতন্ত্র ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং সকলেরই আনুগত্য ছিল একমাত্র রাজার প্রতি। সামাজিক ও আঞ্চলিক গোষ্ঠীর প্রাধান্য নিয়ন্ত্রণ করার সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি ছিল না। এছাড়া, গুপ্তচর প্রথা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। 

■ প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অত্যাচার:-

অশোকের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, অশোক শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজকর্মচারীদের প্রতি নির্ভর করায় এবং তাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল থাকায় প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক শাসকেরা জনসাধারণের উপর অত্যন্ত অত্যাচার চালাতো। অশোকের মৃত্যুর পর এই অত্যাচার চরমে পৌঁছলে সাম্রাজ্যের চতুর্দিকে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

■ স্বতন্ত্র জাতিগুলির বিদ্রোহ :-

নীতিগতভাবে অশোক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্বতন্ত্র জাতি ও উপজাতিগুলিকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিল – অন্ধ্র, পুলিন্দ, কম্বোজ, রাষ্ট্রীক, ভোজ, চোল, পান্ড, সত্যপুত্র ও কেরলপুত্র। পরবর্তীকালে অশোকের মৃত্যুর পর এরাই শক্তিশালী হয়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনে সহায়তা করেছিল। 

■ পরবর্তী সম্রাটদের অযোগ্যতা:-

সম্রাট অশোকের পরবর্তী সম্রাটগণ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধানে সক্ষম ছিল না। রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, জলোকি কাশ্মীরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে কনৌজ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করে ছিল। তারানাথ রচিত গ্রন্থ অনুসারে বীরসেন গান্ধারে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ছিল। সুতরাং, অশোকের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি অন্যতম কারণ। 

■ অর্থনৈতিক অবনতি:-

যদিও সমগ্র উপত্যকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ব্যপক প্রাধান্য ছিল; কিন্তু সাম্রাজ্যের সর্বত্রই অর্থনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থার মধ্যে প্রকার ভেদও ছিল যথেষ্ট। এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয় ফলে গোটা মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর এক চরম অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনে।