সংস্কৃত নাট্যকাররূপে ভাসের নাট্যপ্রতিভা | Bhas Theatrical Talent of Playwright
■ ভাসের নাট্যপ্রতিভা নাট্যকাররূপে ভাসের কৃতিত্ব অবিসংবাদিত। রামায়ণ, মহাভারত বা প্রাচীন লোককথা থেকে নাটকের কাহিনী আহরণ করে কল্পনার রঙে ও প্রতিভাস্পর্শে সেই পুরাতন কাহিনীকে তিনি অভিনব করে তুলেছেন। কল্পিত বৃত্তান্তের সংযোজন ভাসের নাটকগুলিকে নাট্যকলার উৎকর্ষে মণ্ডিত করেছে। ঘটনার সংঘাত বা দ্বন্দ্বই নাটকের প্রাণস্বরূপ।
এই নাট্যদ্বন্দ্ব নাটকীয় উৎকণ্ঠা সৃষ্টির মূল যা ভাসের নাটকগুলিতে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। কাহিনী বিন্যাসের ন্যায় সংলাপ রচনাতেও ভাস ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর সংলাপগুলি সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর, অযথা দীর্ঘায়িত নয়। গদ্য ও পদ্য উভয়বিধ রচনাই এমন প্রাঞ্জল যে মনে হয়, ভাস যেন তৎকালীন সমাজে প্রচলিত কথ্য সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা কুশীলবের মুখে সংলাপ রূপে বসিয়ে দিয়েছেন।
এভাবে শটকের ভাষা কৃত্রিমতা বর্জিত হওয়ায় হয়ে উঠেছে বাস্তবোচিত ও হৃদয়গ্রাহী। সমালোচক A. D. Pusalker- এর মতে–
“The language is very simple , natural and touching alternated with simple figures of speech like simile and metaphor.”
■ অভিনয়ের উপযোগী ঘটনার গতিবেগ ভাসের নাটকগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঘটনার দ্রুততা সম্পাদনের জন্যই নাট্যকার কোন নাটকীয় পাত্রপাত্রীর মুখে যেমন অযথা দীর্ঘ সংলাপ আরোপ করেন নি, তেমনি কোন নাটকীয় পাত্রপাত্রীকে অধিকক্ষণ মঞ্চে আবদ্ধ রেখে দর্শকের বিরক্তি উদ্রেক করেন নি। কালিদাস বা ভবভূতির নাটকের মত ভাসের নাটকগুলিতে কাব্যগুণের উৎকর্ষ হয়তো নেই, তবুও নাটকীয়তার দিক থেকে সেগুলি উচ্চ প্রশংসিত। ভিস্তারনিৎসের মতে ভাস – রচিত নাটকগুলি—
“are all very dra matic, full of life and action.”
চরিত্রচিত্রণেও ভাসের প্রতিভার ছাপ স্পষ্ট। মুখ্য চরিত্রের পাশাপাশি গৌণ চরিত্রগুলিও নাট্যকারের প্রতিভার দীপ্তিতে যেন ভাস্বর হয়ে উঠেছে। সামান্য উক্তি-প্রত্যুক্তিতেই চরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। কর্তব্য ও প্রেমের দ্বন্দ্বে জর্জরিত বাসবদত্তার আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য, প্রতিমা নাটকে পিতার মৃত্যু সংবাদ জানার পর ভরতের হৃদয়বেদনা, পঞ্চরাত্রে শকুনির কুটিলতা, স্বপ্ননাটকে যৌগন্ধরায়ণের নীতি-বিচক্ষণতা, ঊরুভঙ্গে দুর্যোধনের অনুতাপ, কর্ণভার নাটকে দেবতার ছলনার কাছে দানশীল কর্ণের দানের মাহাত্ম্য আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে। তাঁর একাঙ্ক নাটকগুলি পরিসরে ক্ষুদ্র হলেও চরিত্রচিত্রণের গৌরবে অবিস্মরণীয়। পরস্পর বিপরীতধর্মী চরিত্রের সমাবেশের দ্বারা তিনি একটি চরিত্রের মহত্ত্বকে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘দূতবাক্য’ নাটকে দুর্যোধনের নীচতার কাছে শ্রীকৃষ্ণের মহানুভবতা স্পষ্ট। ‘কর্ণভার’ নাটকে দেবরাজ ইন্দ্র ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করে সামান্য মানবে রূপান্তরিত হয়েছেন, কিন্তু দানের গৌরবে মানুষ কর্ণ উন্নীত হয়েছেন দেবতার স্তরে। রসপরিবেশনেও ভাসের কুশলতা লক্ষণীয়। শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, বীর, অদ্ভুত প্রভৃতি রসের সার্থক সংযোজনে ভাস যথার্থ সার্থক।
বিদূষকের বাচনভঙ্গী ভাসের পরিহাস কুশলতার স্বাক্ষরবাহী। অলংকার প্রয়োগেও ভাসের পরিপাটী লক্ষণীয়। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অনুমান, অর্থাদ্ভরন্যাস প্রভৃতি অলংকারের বহুল অথচ সাবলীল প্রয়োগ নাটকগুলিকে উপভোগ্য করে তুলেছে। কাহিনী উপস্থাপনার কৌশলে, সংলাপের সহজ সরল ভঙ্গীতে, নাট্যকলার দক্ষতায়, চরিত্রচিত্রণের সার্থকতায়, রসপরিবেশনের কুশলতায়, ছন্দের সুষমায় এবং অলংকার প্রয়োগের পরিমিতিতে ভাসের নাটকগুলি হয়ে উঠেছে অনবদ্য ও উৎকৃষ্ট। কালিদাস -পূর্ব যুগের নাট্যকার রূপে ভাস যথার্থ প্রথিতযশা।