মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দাও | Describe the Mauryan System of Governance
■ প্রশ:- মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দাও। (Describe the Mauryan System of Governance).
■ উত্তর:- কৌটিল্যের রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’, মেগাস্থিনিসের রচিত ‘ইন্ডিকা’, বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দিব্যবদান’, বিশাখদত্তের রচিত ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, জৈনগ্রন্থ ‘পরিশিষ্টপার্বণ’, পতাঞ্জলির রচিত ‘মহাভাষ্য’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে, অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি সমূহ এবং শাকরাজা রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রশস্তি প্রভৃতি থেকে মৌর্য শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারা যায়। মেগাস্থিনিসের রচনার উপর ভিত্তি করে গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিক স্ট্র্যাবো, অ্যারিয়ান, জাস্টিন, ডায়োডোরাস ও প্লিনি -র রচনা থেকেও এ সম্পর্কে নানান তথ্যা জানতে পারা যায়।
মৌর্য সম্রাটগণ প্রাচীন ভারতে সর্বপ্রথম একটি সুপরিকল্পিত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সমকালীন ও বর্তমানকালের বিভিন্ন পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদ এই শাসনব্যবস্থার বহু প্রশংসায় সামিল হয়েছেন। ড. ভিনসেন্ট স্মিথ -এর মতে, মৌর্য শাসনব্যবস্থা আকবর-প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থার চেয়েও উন্নতি লাভ করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই শাসন ব্যবস্থার মূল কাঠামোটি গঠন করেছিলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক মৌর্য শাসনব্যবস্থার মূল কাঠামোটিকে অপরিবর্তিত রেখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটিয়েছিলেন।
■ মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রশাসনিক স্তরবিন্যাস:- এই বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যে সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যটি বেশকয়েকটি প্রশাসনিক স্তরে বিভক্ত ছিল। এবং সমগ্র সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এই প্রদেশগুলি আবার কতকগুলি ‘বিষয়’ বা ‘আহর’ বা জেলায় বিভক্ত করা হয়েছিল। জেলাগুলি আবার অসংখ্য গ্রামে বিভক্ত ছিল। আর এই গ্রাম ছিল স্বায়ত্তশাসিত মৌর্য প্রশাসনের একেবারে সর্বনিম্ন স্তর।
■ কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা:-
● (১) রাজার ক্ষমতা:- কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় যে, মৌর্য যুগে রাজতান্ত্রিক আদর্শকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। মৌর্য শাসনব্যবস্থায় সম্রাটই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি আইন, শাসন, বিচার, রাজস্ব ও সামরিক প্রায় সমস্ত বিভাগের কাজকর্মের তত্ত্ববধান করতেন। এজন্য গ্রিক দ্রুত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যবস্থাকে ‘কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র’ (Centralized Bureaucracy) বলে অভিহিত করেছেন। তবে স্বৈরাচারী হলেও মৌর্যসম্রাট হিসেবে তিনি কখনোই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। তিনি শাসনকার্য পরিচালনায় ‘মন্ত্রিণ’, ‘মন্ত্রীপরিষদ’ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের থেকে পরামর্শ নিতেন। কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র এবং সম্রাট অশোকের তৃতীয় ও ষষ্ঠ শিলালিপিতে এই মন্ত্রী পরিষদের উল্লেখ পাওয়া গেছে। মন্ত্রীমন্ডলী ছাড়াও অধ্যক্ষ, বলাধ্যক্ষা, নগরাধ্যক্ষ প্রমূখ রাজকর্মচারী রাজাকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দান করতেন।
● (২) বিভিন্ন রাজ কর্মচারী:- কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত দায়িত্ব রাজার হাতে থাকলেও কৌটিল্যের মতে, যেমন একটি চাকার দ্বারা কখনো গাড়ি চলে না, সেইরূপ একা রাজার দ্বারা সঠিকভাবে শাসনকার্য চলত না। তাই মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজাকে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন রাজকর্মচারীরা সহায়তা করতেন। সচিব নামে এক ধরনের কর্মচারী মৌর্য সম্রাটকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাহায্য করতেন । মেগাস্থিনিস এই সচিবদের ‘কাউন্সিল এ্যাণ্ড অ্যাসেসর্স’ (Councillors and Assessors) বলে অভিহিত করেছেন। এই সমস্ত সচিবদের মধ্যে যাঁরা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় অগ্রবর্তী ছিলেন তাঁরা ‘মন্ত্রিণ’ বা মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হয়ে কাজ করতেন।
তাঁরা রাজাকে শাসন ও পররাষ্ট্র বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিতেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রাজার সঙ্গী হতেন। ‘মন্ত্রিণ’ দের নীচের স্তরটিতে ছিল মন্ত্রীপরিষদ নামে একটি পরামর্শদাতা সভা। এর সদস্যরা রাজাকে জরুরি অবস্থার সময় পরামর্শ দান করতেন। তবে এই পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা পুরোপুরি রাজার ইচ্ছাধীন। ‘অমাত্য’ -রা রাজস্ব, অর্থ, বিচার, প্রশাসন প্রভৃতি বিভাগগুলির দায়িত্ব পালন করতেন। অধ্যক্ষ ছিলেন সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলির প্রধান। কৌটিল্যের মতে প্রায় ২৬-২৭ জন অধ্যক্ষ বিভিন্ন দপ্তরের কাজ পরিচালনা করতেন। কেন্দ্রীয় সরকারের দুজন বিশিষ্ট অধ্যক্ষ ছিলেন, তারা হলেন যথা — সমাহর্তা ও সন্নিধাতা। রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিল সমাহর্তা। ‘সন্নিধাতা’ নামে কর্মচারী রাজার কোষাধ্যক্ষ ও হিসাব পরিক্ষকের কাজ করত। এ ছাড়াও, অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রাজকর্মচারীদের মধ্যে ছিল সেনাপতি, করণিক, পুরোহিত, দৌবারিক, প্রতিবেদক, দুর্গাপাল, গুপ্তচর প্রমূখরা।
■ প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা:- শাসনকার্য সঠিকভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে মৌর্য সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছিল। এবং প্রদেশগুলিকে বিভিন্ন জেলায় এবং জেলাগুলিকে বিভিন্ন গ্রামে বিভক্ত করা হয়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে দেশে চারটি প্রদেশ ছিল। পরে সম্রাট অশোক এই চারটি প্রদেশের সঙ্গে কলিঙ্গ প্রদেশটি যুক্ত করেছিলেন।
❏ (১) বিভিন্ন প্রদেশগুলি:- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর সাম্রাজ্যকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন, প্রদেশগুলি হলো যথা— (ক) উত্তরাপথ, (খ) অবন্তী, (গ) দক্ষিণাপথ ও (ঘ) প্রাচ্য। সম্রাট অশোক কলিঙ্গকে তাঁর রাজত্বভুক্ত করার পর মৌর্য সাম্রাজ্য পঞ্চম প্রদেশে পরিণত হয়েছিল।
● (ক) উত্তরাপথ প্রদেশের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা।
● (খ) অবন্তী প্রদেশের-র রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী।
● (গ) দক্ষিণাপথ প্রদেশের -এর রাজধানী ছিল সুবর্ণগিরি।
● (ঘ) প্রাচ্য প্রদেশের -এর রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র।
● (ঙ) কলিঙ্গ প্রদেশের -এর রাজধানী ছিল তোষালী।
❏ (২) প্রাদেশিক শাসক:- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সমস্ত প্রদেশে এক বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। সম্রাট বিভিন্নভাবে প্রদেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা করতেন। সম্রাট অশোকের শিলালিপি থেকে মৌর্য যুগের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রদেশগুলির শাসনকর্তাকে বলা হত ‘কুমার’ বা ‘প্রদেশপাল’। গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলিতে রাজপুত্র বা রাজপরিবারের লোককে শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। এদের নাম ছিল ‘কুমার অমাত্য’ আর অন্যান্য সাধারণ প্রদেশে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিদের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। এদের ‘প্রদেশপাল’ বলে অভিহিত করা হতো। এই ‘কুমার অমাত্য’ বা ‘প্রদেশপাল’ গণ নিজ নিজ এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, রাজস্ব সংগ্রহ, কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা প্রভৃতি দায়িত্বভার পালন করত। কেন্দ্রের মতো প্রদেশগুলির মধ্যেও মন্ত্রিসভা ছিল ।
■ স্থানীয় প্রশাসন:- মৌর্য শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তরটি ছিল গ্রাম। মৌর্য আমলে গ্রামের প্রধান শাসককে বলা হত গ্রামিক। গ্রামিকের দায়িত্ব ছিল গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, চুরিডাকাতি ও অন্যান্য সমস্যার বিচার করা প্রভৃতি। তিনি গ্রামবাসীদের দ্বারা নির্বাচিত হত। গ্রামে সম্ভবত স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। মৌর্য আমলে গ্রামের ওপরের স্তরে পাঁচ থেকে দশটি গ্রামের শাসনের দায়িত্ব থাকত ‘গোপ’ নামে একজন কর্মচারীর হাতে। তাঁর ওপরে ছিল স্থানিক নামে একজন কর্মচারী। সমাহর্তা ছিল জেলার প্রধান শাসক। স্বায়ত্তশাসিত শহরগুলিতে পৃথক ও উন্নত পৌর শাসনব্যবস্থাই চালু হয়েছিল। পাটলিপুত্র, উজ্জয়িনী, তক্ষশিলা, কৌশাম্বী, বৈশালী, শ্রাবন্তী, পুন্ড্রবর্ধন, কাশী প্রভৃতি নগরগুলিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলনিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পৃথক শাসন পরিষদ গড়ে উঠেছিল।
■ পাটলিপুত্রের শাসন প্রণলী:- বিভিন্ন ইতিহাসবিদ মৌর্য সম্রাটদের নগর-শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গ্রিক লেখক মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় পাটলিপুত্র ছিল প্রায় সাড়ে নয় মাইল দীর্ঘ এবং প্রায় দুই মাইল প্রস্থবিশিষ্ট এক বিশাল নগরী। পাটলিপুত্রের শাসন পরিচালনার জন্য একটি পৌরবোর্ড বা পৌর পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এই পৌর পরিষদের সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০ জন। এই বোর্ডকে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। এর প্রতিটি বিভাগে পাঁচজন করে সদস্য ছিল। প্রতিটি বিভাগ নগর-শাসনের জন্য পৃথক ছয়টি দায়িত্ব পালন করত। এই ছয়টি বিভাগ হল — (ক) শিল্প পরিচালনা করা, (খ) বিদেশিদের আপ্যায়ন, (গ) জন্মমৃত্যুর হিসাব সংরক্ষণ, (ঘ) ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, (ঙ) পণ্যসামগ্রী বিক্রির তদারকি, (চ) বিক্রিত দ্রব্যের উপর ১/১০ ভাগ হারে শুল্ক আদায় করা।
■ সামরিক ও গুপ্তচর ব্যবস্থা:- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য তিনি তার সামরিক বিভাগকে ছয়টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ছয়টি বিভাগ হল— (ক) পদাতিক বাহিনী, (খ) অশ্বারোহী বাহিনী, (গ) রথারোহী বাহিনী, (ঘ) রণহস্তী বাহিনী, (ঙ) রণতরী বাহিনী, (চ) রসদপত্র সরবরাহকারী বাহিনী।
■ বিচার ব্যবস্থা:- স্বয়ং রাজাই ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারক। গ্রামের বিচারকার্য গ্রামিক এবং নগরের বিচারকার্য নগর-ব্যবহারিক দ্বারা পরিচালিত হত। এ ছাড়া সংগ্রহণ, স্থানিক, দ্রোণমুখ প্রভৃতি নিম্ন আদালতগুলির অস্তিত্ব ছিল। বিচারের দন্ডবিধি ছিল কঠোর। শাস্তি হিসেবে জরিমানা, জেল, অঙ্গচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড প্রভৃতি ব্যবস্থা করা হত।
■ রাজস্ব ব্যবস্থা:- ভূমিরাজস্বই ছিল সরকারের সমস্ত আয়ের প্রধান উৎস। ভূমিরাজস্ব নগদে বা শস্যের দ্বার প্রদান করা যেত। সাধারণত উৎপন্ন ফসলের ১/৬ বা ১/৪ অংশ রাজস্ব হিসেবে নেওয়া হত। এই করকে হত ‘ভাগ’ নামে অভিহিত করা হত। এ ছাড়াও অন্যান্য বেশকিছু করের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পথকর, জলকর, ফেরিকর, চারণকর, বিবাহকর, জন্ম-মৃত্যু কর প্রভৃতি।