প্রবন্ধ রচনা- একটি সমাজ সেবার অভিজ্ঞতা | Social Service Experience Essay in Bengali
[প্রবন্ধ সূত্র- ভূমিকা | বর্ষার রাতের অভিজ্ঞতা | উদ্ধার কার্য | উপসংহার]
■ ভূমিকা:- শ্রাবণ মাস সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা বাড়ির সামনে রাস্তায় এক হাঁটু জল। সকাল থেকে যেন মনের মধ্যে কেবল একটা অদ্ভুত ভাব। পড়াশোনায় মন বসে না। বাড়িতে কাজের লোক আসেনি। মা নিজের হাতে সব কাজ করছেন। অন্যদিন হলে মা গজগজ করতেন আজ কিন্তু করছেন না। বরঞ্চ মায়ের গলায় সহানুভূতির সুর আহা, বৃষ্টির মধ্যে কী করে আসবে। এই বৃষ্টির মধ্যে স্কুলে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। দুপুরে খেয়ে দেয়ে দিব্যি একটা ঘুম দেওয়া হল। বিকালে জল খাবার খেয়ে পড়ায় মন বসাতে চেষ্টা করলাম।
কিন্তু চেষ্টা করলেই কি বসানো যায়? বৃষ্টির একটানা শব্দ শুনতে শুনতে কেমন নেশা হরে যায়। কোথা থেকে যেন রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসছে। বর্ষা রাতের অভিজ্ঞতা রাত্তিরে সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় ধাক্কা মায়ের গলা — শিগগির ওঠ। বাড়িতে জল ঢুকেছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে এলাম। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, সত্যি সিঁড়ি উপচে জল আমাদের বারান্দায় চলে এসেছে। বাবা-মা ঘরের মেঝে থেকে রাজ্যের জিনিসপত্তর খাটের উপর তুলছেন, আমিও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে তাদের সঙ্গে হাত লাগালাম।
মোটামুটি ঘরের জিনিপত্র সব তুলে ফেলেছি সেই সময় আমাদের ক্লাবের একজন বন্ধু এসে হাজির ‘শিগরির চল পাশের বস্তি ভেসে যাচ্ছে, সাংঘাতিক অবস্থা। বাচ্চা কাচ্চারা জলে ভাসছে। আমি বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। বাবা বললেন, যাও এ অবস্থা তো যাওয়াই তোমার কর্তব্য। আমি বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে এলাম। চারদিক জল থৈ থৈ করছে। রাস্তায় আলো নেই। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই বড়ো এক বস্তি। আমরা সবাই কষ্ট করে সেখানে উপস্থিত হলাম। সত্যিই সাংঘাতিক অবস্থা। বস্তি অঞ্চলটা বেশ নীচু। জল একেবারে ভিতরে ইলেকট্রিকের ঢুকে গেছে। জলে রাশিকৃত জিনিস ভাসছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হল। তারগুলো এমন ভাবে জড়াজড়ি করে আছে যে কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে। আমরা কয়েকজন কিছু ক্ষণের মধ্যে একটা পরিকল্পনা ছকে নিলাম।
■ উদ্ধার কার্য:- প্রথমে বাচ্চাদের কোলে করে। কাছাকাছি কোনো উঁচু বাড়িতে রেখে আসবো। সেইমতো পুরুষদের বললাম, আপনারা বাড়িতে থাকুন। আমাদের সঙ্গে মেয়েও বাচ্ছাদের দিয়ে দিন। কাছেই স্কুলবাড়িতে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। প্রথমটা কেউই যেতে চায় না। পরে অনেক বুঝে সকলকে নিয়ে আমরা কাছের স্কুলবাড়িতে তুলে দিলাম। এই জলের মধ্যে বাচ্চাদের কোলে করে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি একবার তো গর্তের মধ্যে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত নিরাপদে সবাইকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম এটাই তৃপ্তি। এরপর আমরা বস্তিতে গিয়ে ভেসে যাওয়া জিনিসপত্র উদ্ধার করলাম। সেগুলি খোঁজ করে সব বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। বাড়িতে প্রতিটি ঘরের মধ্যেই জল। খাটের উপর খাট পেতে তার উপর সকলে বসে আছে। চোখে অসহায় করুণ দৃষ্টি। ভাবছিলাম, এখনও মানুষের কি অবর্ণনীয় দুর্দশা। এদের জীবনে কোনো আলো নেই। শুধু অন্ধকার। ঘন্টা দুয়েকের এই অভিজ্ঞতা, সত্যিই যেন আমার জ্ঞানের পরিপক্কতা দান করলো। মানুষের দুঃখ দুর্দশার এক চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচিত হল।
■ উপসংহার:- বর্ষারাতের সেই অভিজ্ঞতার কথা আমি ভুলতে পারিনি। চোখ খুললেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। অন্ধকার, জলের মধ্যে আমরা বন্ধুর দল বাচ্চা কোলে করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছি। জলের মধ্যে বসে আছে অসহায় আর্তমানুষের দল। চারধারে যত ভালো ভালো বাড়ি-দোতালা-তিনতালা-চারতলা পাঁচতলা — অথচ এইসব হতভাগ্যের কোনো আশ্রয় নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই এরা বানের জলে ভেসে যায়। মনে মনে ভাবতে লাগলাম। এই সব মানুষদের কর্মে ও কথায় আত্মীয়তা অর্জন করতে হবে, এই সব মূঢ় ম্লান মুক মুখে ভাষা, এইসব শুষ্ক আশা আর ক্ষুধার অন্ন ও আশ্রয়ের জন্য নিশ্চন্ত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।