জীবনী- আশাপূর্ণা দেবী | Ashapurna Devi Biography in Bengali

জীবনী- আশাপূর্ণা দেবী | Ashapurna Devi Biography in Bengali

[সংকেত সূত্র :: ভূমিকা | জন্ম ও পরিবেশ | সাহিত্যনুরাগ | স্মরণীয় সৃষ্টি | সম্মানলাভ | উপসংহার]

ভূমিকা:- বাংলাসাহিত্য-সংস্কৃতি পুরুষ প্রতিভায় উজ্জ্বল হলেও নারী প্রতিভার অনুজ্জ্বল। গৃহকোণে আবদ্ধ থাকায় নারীচেতনার প্রসার ঘটেনি। নারীর লেখার সুযোগ বড়ো আসেনি। স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপাদেবী, কামিনী রায় প্রমুখ লেখিকা ও কবিবৃন্দ অতীত ইতিহাস ও ব্যক্তিগত জীবন ক্ষেত্রের সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকেছেন। নারীজীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা জীবন জটিলতা সমস্যা সংগ্রাম, ব্যর্থতা ও বেদনার বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারেননি। নারীজীবনের অন্তহীন সমস্যার প্রতি সর্বপ্রথম যে লেখিকা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সমাজের দৃষ্টি, তার নাম আশাপূর্ণা দেবী।

■ জন্ম ও পরিবেশ:- সাহিত্যানুরাগী আশাপূর্ণা দেবী ১৯০৯ সালে উত্তর কলকাতার এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে স্কুলে লেখাপড়ার কোনো সুযোগই তাঁর জীবনে ঘটেনি। ভাইরা লেখাপড়া শিখত, তিনি নীরবে থাকিয়ে দেখতেন। মনের মধ্যে লেখাপড়া শেখার অদম্য ইচ্ছা। অথচ সেই ইচ্ছাপূরণের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। জীবনের পাঠশালা থেকে তিনি নিজেই সব শিখেছিলেন। সেই হিসাবে তিনি স্বশিক্ষিতা এবং সুশিক্ষিতা।

■ সাহিত্যনুরাগ:- মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের পর গৃহের অবরোধের মধ্যে থেকে তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন গভীর অন্তর্দিষ্ট দিয়ে। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন সাহিত্য-অনুরাগিনী। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়। এরপর ৬০ বছর ধরে তিনি অক্লান্ত ভাবে গল্প উপন্যাস রচনা করে গেছেন। তাঁর স্মরণীয় সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে আছে প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুলকথা ইত্যাদি।

■ স্মরণীয় সৃষ্টি:- আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য জীবন ৬০ বছরের। এই সময়ের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন শতাধিক গ্রন্থ ও ছোটোগল্প। আশাপূর্ণা দেবী সর্বস্তরে বাঙালি জীবন থেকে তাঁর সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে তাকে আপন হৃদয়ে প্রকাশ করেছেন উপলব্ধির আলোকে। তিনি কখনো পারিবারিক গন্ডীর বাইরে পা দেননি তিনি তাঁর জীবনে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের মতো কোনো ব্যাপক জীবন অভিজ্ঞতা ছিল না, অতি সাধারণ এক সংসারী গৃহবধূ যাকে সংসার স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে অহরহ ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তিনি কোনো যাদুমন্ত্রে বাঙালি জীবনের অন্তঃপুরের অজানা রহস্যের জগতে নির্দ্বিধায় অনায়াসে প্রবেশ করতে পারলেন যা তার আগে কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

তিনি সাধারণ বাঙালি জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা ও জীবন-জটিলতার অতি সুন্দর বাস্তব রূপায়ন করেছেন। তাঁর রূপায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, বাঙালি নারীর অন্তহীন সমস্যা সংগ্রাম ও সাধনা। তাঁর কাহিনির ভাষা নিজের সৃষ্টি। এ ভাষার মধ্যে আছে জীবনের নির্মোহ বর্ণনা, গভীর অন্তর্জালা, নির্মম ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও করুণ বেদনা। তাঁর সাহিত্য ভাষায় আছে অজস্র জিজ্ঞাসার চিহ্ন, তিনি যেন থেকে থেকেই সমাজের মানুষের কাছে অসংখ্য প্রশ্নের তির ছুঁড়েছেন।

■ সম্মানলাভ:- সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ আশাপূর্ণা বিভিন্ন স্থানে হয়েছেন সম্মানিত। ১৯৭৬ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রতিশ্রুতি উপনাসের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় ভারতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে বিশ্বভারতী থেকে তিনি লাভ করেন ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি ১৯৯৪ সালে তাঁকে সাহিত্য একাদেমীর ‘ফেলো’ নির্বাচিত করা হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করে ডি.লিট -উপাধি দান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে নানা সাহিত্য পুরস্কার দান করেন। তাঁর লেখা ইংরাজি, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তাঁর বহু কাহিনি ছায়াচিত্রে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

■ উপসংহার:- আশাপূর্ণ দেবীর কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি বাঙালি মেয়েদের জন্য রেখে গেছেন স্বাধিকার অর্জনের উত্তরাধিকার। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য আশাপূর্ণা দেবী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯৯৫ সালের ১২ ই জুলাই পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি।