শ্রী মা সারদা জীবনী | Sri Ma Sarada Biography in Bengali

শ্রী মা সারদা জীবনী | Sri Ma Sarada Biography in Bengali

[সংকেত সূত্র :: ভূমিকা | জন্ম-বংশপরিচয় ও শিক্ষা | সেবাধর্মের মূর্ত প্রতীক | গরিত্রিক গুণাবলী | আধ্যাত্মিক জীবন | উপসংহার]

ভূমিকা:- মা দেবতার চেয়ে বড়ো। “নাস্তি মাতৃসম গুরুঃ” —মায়ের মতো আর গুরু নেই। আমাদের গর্বের বঙ্গভূমিতে অনেক গরীয়সী মাতা জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের মাতা ভগবতী দেবী, আর সংঘ জননী পরমপুরুষ যুগাবতার রামকৃষ্ণের সহধর্মিনী মা সারদা দেবী। আমি বর্তমান প্রবন্ধে ‘করুণাময়ী মা সারদার’ বিষয় আলোচনা করব।

মা সারদা যে ভক্ত জননী, সংঘমাতা জ্ঞানদায়িনী দেবী অথচ মানবী। ঐশ্বর্যের লেশমাত্র তাঁর ছিল না। এক মহাশক্তি তিনি। সকলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সুখে-দৈন্যে, সম্পদে-বিপদে, দুর্ভিক্ষে মহামারীতে, যুদ্ধ-বিগ্রহে সববিষয়ে মায়ের সেই করুণা, অপার করুণা। শ্রী রামকৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে সকলকে জয় করেছেন। সকলকে করেছেন করুণা। মায়ের কৃপায় ডাকাতগুলো পর্যন্ত ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ২০০৪-এ শ্রী শ্রী সারদাদেবীর সার্ধশতবর্ষ পূর্তি পালন হল সর্বত্র — মহা সমারোহে দিকে দিকে উদযাপিত হল ১৫১ তম জন্মতিথি।

■ জন্ম, বংশ-পরিচয় ও শিক্ষা:- ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগে বাঁকুড়া জেলার জয়রাম বাটীতে সারদামনি বা সারদেশ্বরীর জন্ম। পিতার নাম ছিল রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মাত্র ছ বছর বয়স্কা সারদামণিকে তিনি সেকালের প্রথানুযায়ী গৌরীদান করেছিলেন কামারপুকুরের ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র গদাধর তথা উত্তরকালের শ্রেষ্ঠ সাধক পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের হাতে। শৈশবে পুঁথিগত বিদ্যালাভের কোনো সুযোগ পাননি সারদামণি। পরবর্তী কালে মহাজ্ঞানী স্বামীর কাছে সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে অনেক শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

■ সেবা-ধর্মের মূর্ত প্রতীক:- সারদামণি সাধারণ পল্লিরমণী হয়েও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন না। অস্পৃশ্যতাবোধকে কী করে দূরে সরিয়ে রাখতে হয় তা তিনি নিজের জীবনের আচরণ দিয়ে শিখিয়ে গেছেন। আমজাদ নামে এক নিম্নশ্রেণির মুসলমান ডাকাতকে নিজের হাতেখাইয়ে দিয়ে বাৎসল্য রস উজাড় করে তাকে সৎপথে এনেছিলেন। স্বামীকে সেবা ও জনসেবাতেই তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

■ চারিত্রিক গুণাবলী:- কায়িক পরিশ্রমে মা সারদা কোনো দিনই কুণ্ঠা ছিল না। গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজকর্ম নিজের হাতেই করতেন। সহনশক্তি ও আত্মবিশ্বাসও ছিল অপরিসীম। ভয় বলে কিছু জানতেন না তিনি। একবার তিনি যেভাবে জয়রামবাটি থেকে পায়ে হেঁটে ডাকাতের ভয় তুচ্ছ করে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থি হয়েছিলেন তা ভাবতে গেলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। সারাজীবন কঠোর মানসিক বল ও সহিষুতার পরিচয় দিয়েছেন। সংসারে বাস করেও সাংসারিক জীবনে সম্প নিরাসক্ত ও ব্রহ্মচারিণী ছিলেন। তাঁর সহজ-সরল অনাড়ম্বর ত্যাগ-পূত জীবনই যে তাঁর বাণীর মূর্ত প্রকাশ। তিনি মানুষকে সাহস দিয়ে বলতেন— “দুঃখবাধা, বিঘ্ন এ সংসারে সবার হয়। কিন্তু যিনি ভক্ত (পরমশক্তির) তাঁর সহজে সব হন তা পার পরের ত্রুটি দেখতে নাই, পরনিন্দা ঘোর বালাই।”

■ আধ্যাত্মিক জীবন:- রামকৃষ্ণের শিষ্য ও ভক্তদের কাছে সারদাদেবী ছিলে ‘শ্রীমা’। স্বামীর সকল শিষ্য ও ভক্তদের তিনি সন্তানবৎ স্নেহ করতেন। পরমংসদেে তিরোধানের পর, বহুতীর্থ পরিক্রমার শেষে বেলুর মঠে অবস্থান, পূজাপাঠ ও আতুরজনের সেবা শুশ্রূষার মধ্যে দিন যাপন করেন। স্বামীর কাছ থেকে শাস্ত্র পুরাণ উপনিষদ, প্রভৃতির যে সব তত্ত্ব আয়ত্ত করেছিলেন, তা থেকেই তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের বনিয়াদ সুদৃঢ় হয়। স্বামীর মতোই সহজ-সরল ভাবে আধ্যাত্মিক বিষয়ের আলোচনা করতে পারতেন।

■ উপসংহার:- ১৯২০ খ্রিঃ সারদামণি ইহত্যাগ করেন। শ্রীমা সারদা শুধু বাংলার একজন মহীয়সী নারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতের এক আদর্শ নারী চরিত্র। তাঁর মধ্যে জিশু মাতামেরীর অপার করুণা সীতা সাবিত্রির পাতিব্রত্য, মা যশোদার বাৎসল্য আধুনিকা সেবাব্রতী ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেলের সেবপরায়ণতা যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তাঁর মতো নারীর জীবনাদর্শকে স্মরণ করে, মিথ্যা, মেকি অন্তঃসারশূন্য ধর্মীয় উন্মাদনার ধার না ধেরে অর্থাৎ পাত্তা না দিয়ে নির্ভীক ভাবে কবির ভাষায় বলা যায়। — যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক। আমি তোমায় ছাড়বো না মা। তোমার চরণ করব শরণ আর কারো ধার ধারবো না।