পশ্চিমবঙ্গের বন্যা | Floods in West Bengal Essay Writing
[প্রবন্ধ সংকেত :: ভূমিকা | বন্যার কারণ | বন্যার ক্ষয় ক্ষতি | প্রতিকার | উপসংহার]
■ ভূমিকা:- অরণ্য, নদী, এগুলি মানুষের বন্ধু। নদীর করুনা ধারায় ধরণী হয় শস্যবতী। নদীই গড়ে তুলেছে সভ্যতা। কিন্তু এই নদীরই দুই ভিন্নরূপ। একরূপে নদী মানুষের কীর্তি রচনা করে। অন্যরূপে কীর্তি নাশ করে। এক রূপে শুভদা আর একদিকে নদী সংহারকারিণী। সভ্যতা গড়ে তোলার উগ্র মোহে মানুষ এই নদীকেই সেতু-শৃঙ্খলে বন্দি করল। নেমে এলো প্রকৃতির অভিশাপ। বন্যা তারই রূদ্ররূপ।
■ বন্যার কারণ:- বন্যার মূল কারণ অতিবৃষ্টি ও জল নিকাশের সীমিত পথ। দামোদর, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি কয়েকটি নদ-নদীর অববাহিকা। যেখানে দফায় দফায় প্রবল বর্ষণ। সেই বর্ষণের ফলে হয় বন্যা। বন্যা হয় জলবিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট জলাধার থেকে। একরূপে বহুল পরিমাণে জল ছেড়ে দেওয়ার ফলে। একই সময়ে নালায় ওপরের দিকে জল নিকাশের বাধার সৃষ্টি হয়।
বানের জন্য হয় বন্যা। এক সময় বর্ষাকালে দামোদরের ছোটো ছোটো বন্যাগুলো প্রবাহের ভরবেগের সাহায্যে মোহনার খাতের চর কেটে সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দিত। দামোদরের ওপর বাঁধ দেওয়া হল। বন্ধ হল সেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
ফলে হুগলি নদীতে নতুন নতুন বিপর্যয়ের ধাক্কা এলো। ফারাক্কায় গঙ্গায় তৈরি হল ‘ব্যারেজ’। এতে গঙ্গা-পদ্মার খাত মজল। ফলে পদ্মার বন্যা ঠেলা মেরে মাথাভাঙ্গা, জলঙ্গি, চূর্ণী, ইছামতী দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্লাবিত করল। নিম্নাংশে কাঁসাই, হলদিয়ার জল নিকাশের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হল না কলে কংসাবতী বাঁধের। মেদিনীপুর জেলায় বৃদ্ধি পেল প্লাবন। কোনো নদীতে বাঁধ দিলে নিম্ন উপত্যকার বন্যা প্রবণতা বাড়ে। নদীর বাঁকও নানা ভাবে নদীর ক্ষতি করে। নদীপথ কোথাও সঙ্কীর্ণ কোথাও বিস্তৃত। বিস্তৃত নদীর সর্বত্র বিশেষ করে মাঝ নদীতে সঞ্চিত হতে থাকে পলি। উঁচু হয়ে ওঠে নদীখাত। ঢাল নদীকে গতি দেয়। অনেক নদীপথে ঢাল কম বা নেই। পাহাড়ি পথ ধরে দুরন্ত গতিতে নেমে আসে বর্ষার বিপুল জলরাশি। সেই জল এসব চলহীন পথে জমা হয়। নদী স্ফীত হয়। সৃষ্টি হয় বন্যার। সেতু ও ব্যারাজ তৈরির ভুল ত্রুটির জন্যও আজ বন্যার এত প্রকোপ।
■ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি:- বন্যা এক দুঃস্বপ্ন। বন্যা আসে। বন্যা চলে যায়। রেখে যায় তার ক্ষত চিহ্ন। এরই মধ্যে ১৯৪৩, ৫৬, ৫৯, ৭৩, ৭৮, ৮৭, ৯১, ৯৮, ২০০০, ২০০১, ২০০৪ এ বন্যা এসেছে। অনেক জীবন নিয়ে, সব লণ্ড ভণ্ড করে দিয়ে চলে গেছে। কে জানে, ভবিষ্যতে তার খেয়ালিপনায় আরও কত কী ঘটবে। বন্যা বহু জনপদ ভাসায়, নিশ্চিহ্ন করে ঘরবাড়ি। মৃত্যু এসে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের ওপরে। এবারের (২০০৪) বন্যা এসেছিল আকস্মিক। মূলত একটানা একসপ্তাহ প্রবল বর্ষণের ফলে এবারের বন্যা হয়েছে। নদীনালা ক্ষিপ্ত হয়ে ফুলে ফেঁপে ছুটে এসেছে। বহু শস্যের ক্ষতি হয়েছে। ছিনিয়ে নিয়েছে কিছু জীবন।
■ বন্যার প্রতিকার:- কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন নিয়ে মানুষ চুপ করে বসে থাকেনি। বন্যাপ্রতিরোধে মানুষ সংকল্প বন্ধ হয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সরকারি পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছে বন্যানিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা। এদের মধ্যে ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, ফরাক্কা বাঁধ, তিস্তা-জলঢাকা দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য। তবে কিছু ত্রুটি আমাদের থেকেই গেছে। আমাদের আজকে সেই ত্রুটি মোচনের কথা ভাবতে হবে। আজ প্রয়োজন নদীপথের সুষম বিস্তার ও গভীরতা। আজ দরকার সর্বত্র ঢাল সৃষ্টি ও উপনদী মূল নদীর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ যোগাযোগ ফিরিয়ে আনতে হবে নদীর নাব্যতা। রোধ করতে হবে ভূমিক্ষয়, গ্রহণ করতে হবে বৃক্ষ রোপণের প্রয়োজনীয় কর্মসূচী। বাঁধের জলাধারগুলি বাড়াতে হবে।
■ উপসংহার:- বন্যা মানুষের কাছে আতঙ্ক। কিন্তু বন্যা শুধু ধ্বংসই করে না। সে ধরণীকে নতুন সাজে সাজায়। পলি ছড়িয়ে জমিকে উর্বর করে। পৃথিবীকে করে শ্যামলী করে শস্যময়ী। বিজ্ঞান বুদ্ধি তার সহায়। তার দুঃখ হরনের হাতিয়ার। হোয়াংহো নদীও একদিন চিনের মানুষের কাছে ছিল দুঃখের কারণ। সেই নদীই মানুষের সাধনার কাছে বশ মেনেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়তো থাকবেই। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত কর্মনিষ্ঠায়, উন্নত প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে বন্যা চিরকালের মতো বিদায় নেবে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সেদিন আসুক, এই কামনা করি।