চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী | Story of Chandimangal Kavya

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী | Story of Chandimangal Kavya

■ ভূমিকা:- চণ্ডীমঙ্গল চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। এই চণ্ডীদেবী কে তা নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। সম্ভবত তিনি অনার্যদের দেবী, পশুদের দেবীরূপে পূজিত হতেন। তিনি শক্তিদেবী, শিবের পত্নী। লৌকিক চণ্ডীকে মঙ্গলকাব্যের কবিরা দুর্গা আর অন্নদার সঙ্গে এক করে দেখেছেন।

■ কাহিনী:- চণ্ডীমঙ্গলের নরখণ্ডে দুটি কাহিনী। একটি কালকেতু ব্যাধের কাহিনী, অন্যটি ধনপতি সদাগরের আখ্যান। মনসামঙ্গলের তুলনায় চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী দীর্ঘ। দেবী চণ্ডী মনসার মত ভয়ঙ্করী নন। চণ্ডীর কৌশলে শিবের অভিশাপে ইন্দ্রের ছেলে নীলাম্বর এবং তাঁর স্ত্রী ছায়া মর্তে কালকেতু ও ফুল্লরা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এঁরা ছিলেন ব্যাধদম্পতি। কালকেতু পশু শিকার করেন আর ফুল্লরা পশুমাংস হাটে বিক্রি করেন। দরিদ্র হলেও সুখে তাঁদের দিন কাটছিল। কালকেতুর অত্যাচার জর্জরিত বনের পশুরা চণ্ডীদেবীর শরণ নিল। দেবী নিজের পুজো প্রচারের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন।

তিনি বনের পশুদের কালকেতুর চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখলেন। দিনের পর দিন শিকার না পেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় কালকেতু অস্থির হয়ে উঠলেন। দেবী একদিন সোনালী গোসাপের রূপ ধরে পথের পাশে পড়ে রইলেন। কালকেতু তাকে দেখতে পেয়ে বেঁধে বাড়ি নিয়ে এলেন। কালকেতু – ফুল্লরার অনুপস্থিতিতে দেবী পরমাসুন্দরী নারীর রূপ ধরে বসে রইলেন। কালকেতুর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের প্রমাণ পেয়ে দেবী তাঁকে সাতঘাড়া ধন ও এক দামি আংটি দিলেন। সেই অর্থের সাহায্যে কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করলেন। গুজরাটের রাজা হলেন কালকেতু। সাড়ম্বরে চণ্ডীর পুজো হল। তাঁর সুখসম্পদের শেষ নেই।

এদিকে গুজরাট নগরে ভাঁড়ু দত্ত বলে এক ধূর্ত প্রতারক নগরবাসীদের উপর অত্যাচার করে টাকাকড়ি আদায় করতে লাগল। কালকেতু তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন। অপমানিত ভাঁড়ু দত্তের প্ররোচনায় কলিঙ্গরাজ গুজরাট আক্রমণ করলেন। সুদিনে কালকেতু দেবীর কথা ভুলে গিয়েছিলেন। কালকেতু পরাজিত ও বন্দি হলেন। শেষে চণ্ডীর আরাধনা করে কালকেতু-ফুল্লরা হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন। মর্তে চণ্ডীর পুজো প্রচার শেষ করে তাঁরা স্বর্গে ফিরে গেলেন। চণ্ডীমঙ্গলের দ্বিতীয় কাহিনীটি ‘বণিক’ খণ্ড নামে পরিচিত। উজানীনগরের প্রধান বণিক ছিলেন ধনপতি সদাগর। সমুদ্রপথে তাঁর বাণিজ্যতরী নিত্য যাতায়াত করে। তাঁর স্ত্রী লহনা নিঃসন্তান ছিলেন। তাই সদাগর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে খুল্লনাকে ঘরে আনলেন।

সদাগর বাণিজ্যে গেলে লহনা খুল্লনার উপর অত্যাচার শুরু করে। তাকে বনে ছাগল চরাতে পাঠানো হল। রাতে ঢেঁকিশালে শুতে দেওয়া হল। গ্রামে মেয়েদের মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করতে দেখে খুল্লনা দেবীর পুজো করে বিপদমুক্ত হল। ধনপতি দেশে ফিরে আসেন। খুল্লনার সুখ-সৌভাগ্যের সীমা নেই। যে যখন সন্তান-সম্ভবা, ধনপতি তখন আবার বাণিজ্যযাত্রা করেন। যাত্রার সময় দেখলেন খুল্লনা ঘট পেতে চণ্ডীর ব্রত করছে। ধনপতি ছিলেন শিবের উপাসক। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ঘটে লাথি মারলেন। এর ফলে বাণিজ্যপথে তাঁকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হল। সিংহল যাবার পথে কালীদহে তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। পদ্মাসনা এক দেবী একটি হাতি গিলছেন আবার উগড়ে দিচ্ছেন। এটি আসলে চণ্ডীদেবীর ছলনা। সিংহলরাজের কাছে ধনপতি ‘কমলে কামিনী’র গল্প করলেন, কিন্তু রাজাকে এই দৃশ্য দেখাতে পারলেন না বলে কারারুদ্ধ হলেন।

এদিকে খুল্লনার ছেলে শ্রীমন্ত বড় হয়ে উঠল। মায়ের মতো দেবীর প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি। বাবাকে উদ্ধার করার জন্য তিনি সিংহল যাত্রা করলেন। পথে দেখলেন কমলে কামিনীর সেই অদ্ভুত দৃশ্য। সিংহলরাজকে এই দৃশ্য দেখাতে না পেরে তিনিও কারারুদ্ধ হলেন। জেলখানায় পিতাপুত্রের প্রথম দেখা। চণ্ডীর স্তব করে অবশেষে পিতাপুত্র উদ্ধার লাভ করেন। সিংহল – রাজকন্যা সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিয়ে হয়তে ধনপতি সদাগর পুত্র আর পুত্র-বধূ এবং প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। তাঁদের উদ্যোগে মর্তে চণ্ডীপুজোর প্রচলন হল।