সংস্কৃত গদ্যকাব্যে বাণভট্টের ভূমিকা | Banabhatas Role in Sanskrit Prose Poetry

সংস্কৃত গদ্যকাব্যে বাণভট্টের ভূমিকা | Banabhatas Role in Sanskrit Prose Poetry

■ বাণভট্ট সংস্কৃত গদ্যকাব্যের জগতে বাণভট্ট কবিসার্বভৌম। আলংকারিকদের মতে গদ্যরচনাই হল কবিলেখনীর নিকষিত হেম— “গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি।” বাণভট্ট গদ্যরচনার পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘হর্যচরিত’ – এর প্রথম আড়াই উচ্ছ্বাসে বাণ তাঁর বিস্তৃত-বংশপরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। বাৎসায়ন বংশীয় চিত্রভানুর পুত্র বাণ।

বাণের পিতামহের নাম অর্থপতি। শৈশবে বাণ মাতৃহারা হন। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। কিশোর বাণ পিতৃশোকে আকুল হয়ে বিভিন্ন প্রকৃতির বন্ধুদের সঙ্গে মিশে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েন এবং দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ভ্রাতা কৃষ্ণের সহায়তায় তিনি হর্ষবর্ধনের রাজসভায় স্থান লাভ করেন এবং অচিরেই বিদ্বৎপ্রিয় রাজার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন। হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালেই (৬০৫-৬৪৮ খ্রীষ্টাব্দ) বাণের কবিপ্রতিভা চরম উৎকর্ষ লাভ করে।

বাণভট্ট সংস্কৃত সাহিত্য জগতকে দুটি গদ্যকাব, উপহার দিয়েছেন— হর্ষচরিত এবং কাদম্বরী। ‘দূর্ষচরিত’ আখ্যায়িকা শ্রেণীর গদ্যকাব্য। গ্রন্থের প্রধম আড়াইটি উচ্ছ্বাসে বাণ আত্মপরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন, তারপর শুরু হয়েছে পুষ্যভূতি বংশের কাহিনী। প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যু, গ্রহবর্মার সঙ্গে রাজ্যশ্রীর বিবাহ, মালবরাজের দ্বারা গ্রহকর্মার নিধন, রাজ্যশ্রী অপহরণ, গৌড়েশ্বরের চক্রান্তে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু, হর্ষের যুদ্ধযাত্রা, রাজ্যশ্রী উদ্ধার প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনার কাব্যোচিত বর্ণনায় হর্ষচরিত সমৃদ্ধ।

এটি ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত হলেও এখানে ইতিহাস গৌণ, কাব্যশিল্পই মুখ্য হয়ে উঠেছে। দিবাকরমিত্রের আশ্রমে সর্বধর্ম সমাবেশ বর্ণনা, বিন্ধ্যগিরির বর্ণনা, সন্ধ্যা ও যুদ্ধের বর্ণনা প্রভৃতিতে কবির ভূয়োদর্শন এবং বিবিধ শাস্ত্রনিষ্ণাততার ছাপ স্পষ্ট। রাজ্যশ্রীর বিবাহ উপলক্ষ্যে উৎসবের আতিশয্য এবং নৃত্য-গীত-বাদ্যের সাড়ম্বর বর্ণনা কবির ভূয়োদর্শনেরই ফলশ্রুতি।

প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুতে প্রিয়জনের শোকবিহ্বলতার বর্ণনা সত্যই মর্মস্পর্শী। কবির বর্ণনায় একদিকে যেমন আছে সমাসবছঃ ওজোগুণের সমাবেশ, তেমনি আছে বিষয়ানুগ সরল অনাড়ম্বর বর্ণনার স্নিগ্ধ সরলতা। বর্ণনার বৈচিত্র্যে, শব্দের গাম্ভীর্যে ও মণ্ডনবলার প্রাচুর্যে কবি তাঁর রচনাকে যথার্থ কাব্যধর্মী করে তুলেছেন। হর্ষচরিত যেন অলংকৃত এক অপরূপ কাব্যহম। ‘কাদম্বরী’ বাণের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা এবং কথা জাতীয় গদ্যকাব্য। কল্পনার স্বাধীনতায়, বর্ণনার স্বচ্ছন্দচারিতায় এবং প্রতিভার দীপ্তিতে কবি তাঁর এই কাব্যকে বিচিত্রতায় পূর্ণ করে তুলেছেন। ‘কাদম্বরী’ শব্দের অর্থ সুরা। সুরার মাদকতায় মানুষ যেমন মত্ত হয়, কাদম্বরী -কাব্যরস পানেও পাঠক তেমনি আনন্দে বিভোর হন, আহারেও তাঁদের রুচি থাকে না। তাই বলা হয়—

“কাদম্বরীরস-জ্ঞানামাহারোঽপি ন রোচতে।”

এই গদ্যকাব্যের পূর্বভাগ বাণের রচনা, উত্তরভাগ রচনা করেন বাণের পুত্র ভূষণভট্ট বা পুলিন্দ। কাদম্বরী হল তিন জন্মে সংক্রমিত অমর প্রেমকাহিনী। কাহিনীর বক্তা শূদ্রকের রাজসভায় চণ্ডালকন্যা মাতঙ্গিনীর দ্বারা আনীত একটি শুকপাখী। এর নায়ক চন্দ্রাপীড় এবং নায়িকা কাদম্বরী। নায়ক-নায়িকার প্রেমকাহিনীর পাশাপাশি বর্ণিত হয়েছে পুণ্ডরীক ও মহাশ্বেতার প্রণয়বৃত্তান্ত। ব্যাধের হাতে শুকপাখিটির পিতার মৃত্যু হলে জাবালি মুনি তাকে প্রতিপালন করেন এবং তার পূর্বজন্মের কথা শোনান। শুকপাখিটি পূর্বজন্মে ছিল বৈশম্পায়ন এবং রাজা শূদ্রক পূর্বজন্মে ছিলেন চন্দ্রাপীড়।