দক্ষিণ ভারতে মোপলা বিদ্রোহের বর্ণনা | Moplah Rebellion in South India
■ কেরল রাজ্যের মালাবার উপকূলে একটি মুসলমান কৃষক সম্প্রদায় হল মোপলা। এদের পূর্বপুরুষরা কোনো এক সময় আরবদেশ থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। চাষবাস -ই ছিল এদের জীবিকা। জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারে জর্জরিত মোপলারা খুবই দরিদ্র ও অসহায় ছিল। এই দারিদ্র তাদের এমনই দুর্ধর্ষ ও হিংস্র করে তুলেছিল যে এদিক থেকে তারা ভারতের একটি বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিল।
অবশেষে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এরা ব্রিটিশ শাসনেরও আর্থিক শোষণের শিকারে পরিণত হলে শুরু হয় মোপলা সম্প্রদায়ের আত্মরক্ষার সংগ্রাম; যা ভারতের সশস্ত্র গণ-সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। মহাবিদ্রোহের আহ্বানের রেশ তখনও মিলিয়ে যায়নি; ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন নতুন গণ-বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মোপলা বিদ্রোহ ছিল তারই একটি। তবে এটি চলেছিল দীর্ঘ দিন ধরে। ১৮৭৩ থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট পাঁচবার মোপলারা লাঠি, তরবারি, তির-ধনুক ইত্যাদি মামুলি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশের পুলিশ-সৈন্য-আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রতিটি বিদ্রোহেই মোপলারা উন্নত শক্তির কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরাজিত হয়েছিল। আর প্রতিটি বিদ্রোহ শেষে তাদের ওপর নানাভাবে নানাদিক দিয়ে অত্যাচারের মাত্রাও গিয়েছিল বেড়ে।
এতদ্সত্ত্বেও তারা বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে পিছপা হয়নি। ১৮৮৫, ১৮৯৪, ১৮৯৬ ও ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে দ্বিতীয় থেকে পঞ্চমবার পর্যন্ত তারা বিদ্রোহ করে। তবে তৃতীয়বার বিদ্রোহের (১৮৯৪ খ্রিঃ) পর জমিদাররা খাজনার পরিমাণ ও মহাজনরা সুদের হার অত্যধিক বাড়িয়ে দিলে খাজনা ও ঋণের দায়ে হাজার হাজার মোপলা চাষি যখন পথের ভিখারি, তখনও তাদের লাঙল, বলদ, ঘটি-বাটি ইত্যাদি কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে তাদের বাড়িঘরও ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হতে থাকলে মোপলাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝার মতো তারা বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই চতুর্থ বিদ্রোহের ভয়াবহ রোষের প্রচণ্ডতায় মহাজন-জমিদার শ্রেণি-তো বটেই, ব্রিটিশ সরকারও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। হাজার হাজার সহায়-সম্বলহীন, প্রায়-নিরস্ত্র মোপলা চাষির আঘাতে দক্ষিণ ভারতের ব্রিটিশ শাসন কেঁপে ওঠে।
এই বিদ্রোহে উভয় পক্ষের বহু লোক হতাহত হয়। এরপরই ভীত ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের বর্ধিত খাজনা ও মহাজনদের বর্ধিত সুন্দ আদায় বন্ধ করে দিয়ে খাজনা ও সুদের হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এইভাবে মোপলা চাষিদের শান্ত করার চেষ্টা হয়।