উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতি | Nature of Liberal Democratic Systems
■ প্রশ্ন:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো। অথবা, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর একটি টীকা লেখো। (Nature of Liberal Democratic Systems).
■ উত্তর:- উদারনৈতিক গণতন্ত্র হল এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এর মধ্যে উদারনৈতিক দর্শন, চিন্তা ও ভাবধারা প্রতিপন্ন হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদারনৈতিক দর্শনের বাস্তবায়ন এর মূল লক্ষ্য। মোটামুটিভাবে সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার বিকাশ ঘটে।
এই সাবেকী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দু’টি মূল নীতি হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা এ দু’টি নীতির স্রষ্টা হিসাবে পরিচিত।
পরবর্তীকালে বেন্থাম, জেমস্ মিল, জে.এস.মিল প্রমুখ দার্শনিক উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করেন। তার ফলে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও হিতবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে ক্রমশঃ সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার আবির্ভাব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে সাবেকী উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটে। ডিউই (John Dewey), কোহেন (M. R. Cohen) প্রমুখ চিন্তাবিদ্গণ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আধুনিক রূপকে ব্যক্ত করেছেন।
উদারনৈতিক গণতন্ত্র হল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বিশিষ্ট রূপ। সাম্য, স্বাধীনতা ও অধিকার হল এর মূল নীতি। মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
■ (১) রাজনৈতিক সাম্য:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। জনসাধারণকেই যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার একমাত্র উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে জনগণের শাসন কার্যতঃ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। কারণ বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা দুই-ই বিশাল ও বিপুল।
তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণ পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। এইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলেও গণতান্ত্রিক সরকার কার্যত সর্বসাধারণের মঙ্গলার্থে পরিচালিত হয়। কোন বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর স্বার্থে সরকার কাজ করে না।
■ (২) সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ:- এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ অবহেলিত হয় না। তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিবিধ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন, বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়।
■ (৩) পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে নাগরিক জীবনের সমুদয় পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারী চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি সবরকম রাজনৈতিক অধিকার ভোগের সুযোগ উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বর্তমান থাকে। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই সমস্ত অধিকার সংবিধানেই বিধিবদ্ধ আছে।
■ (৪) আইনের অনুশাসন ও ন্যায়বিচার:- এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য এবং আইনসমূহের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার উদারনৈতিক গণতন্ত্রে স্বীকার করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ধারায় এর উল্লেখ আছে।
■ (৫) বহুদলীয় ব্যবস্থা:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর বহুবিধ স্বার্থ ও প্রতিনিধিত্ব সম্ভব হয়। তাছাড়া, বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীন দলের স্বৈরাচারী মনোভাবকে প্রতিহত করে গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখতে পারে।
■ (৬) সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার:- সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। গণ-সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারকে অপরিহার্য মনে করা হয়।
■ (৭) শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পরিবর্তন:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের জন্য হিংসাত্মক বা বৈপ্লবিক কোন পন্থা অবলম্বন করতে হয় না। সাংবিধানিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবেই সরকার বদল করা যায়।
■ (৮) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা:- এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য উদারনৈতিক গণতন্ত্রে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার কথা বলা হয়।
■ (৯) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে পরিগণিত হয়। বর্তমানে কোন কোন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর কিছু কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের অধ্যায় থেকে বাদ দিয়ে সাধারণ আইনগত অধিকারে পরিণত করা হয়েছে।
■ (১০) জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব:- জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতার নীতির পরিবর্তে পরিকল্পিত গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়করণ, গতিশীল করব্যবস্থা প্রভৃতি গ্রহণ করা হচ্ছে।
■ (১১) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব:- চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সরকারী সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক সংগঠনের উপর কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বার্থগোষ্ঠীগুলি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়।
■ (১২) আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জনকল্যাণমূলক আদর্শ ও সরকারের রাজনৈতিক অংশের ঘন ঘন পরিবর্তনের জন্য সরকারের অ-রাজনৈতিক অংশ বা স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদের গুরুত্ব ও প্রাধান্য অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ উদারনৈতিক গণতন্ত্র বহুলাংশে আমলাতান্ত্রিক রূপ ধারণ করে।
■ (১৩) গণসংযোগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা:- উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সংবাদপত্র, বেতার প্রভৃতি গণসংযোগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা স্বীকৃত। এগুলিকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। গণসংযোগের মাধ্যমগুলি সরকারের সমালোচনা করতে পারে।