গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য | Difference Democracy and Dictatorship
■ প্রশ্ন:- গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যগুলি আলোচনা করো। (Difference Democracy and Dictatorship).
■ উত্তর:- গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র দু’টি পরস্পর-বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ। এই দুই শাসনব্যবস্থা বিপরীত ধর্মী। প্রকৃতি ও গুণগত বিচারে উভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বর্তমান। উভয় প্রকার শাসনব্যবস্থার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য বিচার করলে দেখা যায় যে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে ওণ, একনায়কতন্ত্রের ক্ষেত্রে তা দোষ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। আবার একনায়কতন্ত্রের দোষ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে গুণ হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
■ (১) তত্ত্বগত ভিত্তিতে পার্থক্য:- তত্ত্বগত ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। মানবতার মহান আদর্শ, হিতবাদী তত্ত্ব এবং মিলের আদর্শবাদী তত্ত্বের উপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। অপর দিকে একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিভূমি হল হেগেলীয় আদর্শবাদ।
■ (২) গণতন্ত্রে জনগণের শাসন, নায়কতন্ত্রে নায়কের শাসন:- গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা পরিচালিত জনগণের শাসনব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠী বলতে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বোঝায়। আর একনায়কতন্ত্রের যিনি নায়ক, তিনিই হলেন সর্বেসর্বা। তিনি অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কিন্তু জনসাধারণের প্রতিনিধি নন।
■ (৩) গণতন্ত্রে সাম্য নীতি, নায়কতন্ত্রে জাতিতত্ত্ব স্বীকৃত:- গণতন্ত্র সাম্য ও সমানাধিকারের নীতিতে আস্থাশীল। কিন্তু একনায়কতন্ত্র জাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী এবং সাম্যনীতির পরিপন্থী। গণতন্ত্র সকল রকম বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধী। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন করা হয়।
■ (৪) গণতন্ত্রে ব্যালট, নায়কতন্ত্রে বুলেট:- গণতন্ত্রে শাসনের ভিত্তি হল শাসিতের সম্মতি। এখানে ক্ষমতার উৎস হল ব্যালট। অপরপক্ষে একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হল বুলেট এবং শাসনের ভিত্তি হল পশুশক্তি। গণ-তন্ত্রে জনগণ নিজের স্বার্থে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে নায়ক পুলিশ, সৈন্য প্রভৃতির সাহায্যে জনসাধারণের উপর পশুশক্তির শাসন কায়েম করেন।
■ (৫) গণতন্ত্রে ব্যক্তি, কিন্তু নায়কতন্ত্রে রাষ্ট্ররই প্রাধান্য:- একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আগে রাষ্ট্র, পরে ব্যক্তি। এখানে রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়। কিন্তু গণতন্ত্রে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলসাধনই রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এখানে আগে ব্যক্তি পরে রাষ্ট্র। গণতন্ত্রে ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্র , রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়।
■ (৬) গণতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকৃত, নায়কতন্ত্রে অস্বীকৃত:- গণতন্ত্র জনসাধারণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। এই শাসনব্যবস্থা স্বাধীনতার পরিপোয়ক। পক্ষান্তরে, একনায়কতন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী। গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। পক্ষান্তরে, একনায়কতন্ত্রে স্বৈরাচারের অতিশাসন কায়েম হয়।
■ (৭) বৃহস্রাষ্ট্রের পক্ষে গণতন্ত্র উপযোগী; নায়কতন্ত্রে নয়: গণতন্ত্র বিশালকায় দেশের পক্ষে বিশেষভাবে উপযোগী। কারণ ক্ষমতা এখানে বিকেন্দ্রীভূত থাকে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। তাই একনায়কতন্ত্র ক্ষুদ্রকায় দেশের পক্ষে কাম্য হলেও, বিপুলায়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রে অচল।
■ (৮) গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত, নায়কতন্ত্রে নয়:- গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। একনায়কতন্ত্রে কিন্তু স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করা হয় না। একনায়কতন্ত্রের সুশাসনও যতই ত্রুটি মুক্ত হোক না কেন, স্বায়ত্তশাসন বিকল্প হতে পারে না।
■ (৯) গণতন্ত্রে বিপ্লবের আশঙ্কা নেই, নায়কতন্ত্রে আছে:- স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত বলে গণতন্ত্রে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। এখানে তাই জনগণের মনে কোন ক্ষোভ থাকে না। এই কারণে গণতন্ত্র বিপ্লব-বিদ্রোহের আশংকা থেকে মুক্ত। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র প্রভাব ব্যক্তিজীবনকে গ্রাস করে। তার ফলে জনমনে ক্ষোভ ও তিতিক্ষা জমতে থাকে। তাই একনায়কতন্ত্রে বিপ্লবের আশঙ্কা সর্বদা বর্তমান থাকে।
■ (১০) গণতন্ত্র বিশ্বশান্তির অনুপন্থী, নায়কতন্ত্র পরিপন্থী:- গণতন্ত্র সকল ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের পরিপোষক। সকল রকম বলপ্রয়োগকে অস্বীকার করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার আদর্শে গণতন্ত্র আস্থাশীল। অপরপক্ষে, একনায়কতন্ত্রে উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ যুদ্ধের বিভীষিকার সৃষ্টি করে। একনায়কতন্ত্র তাই, বিশ্বশান্তির পরিপন্থী।
■ (১১) গণতন্ত্রে বহুদল, কিন্তু নায়কতন্ত্রে একটি দল:- গণতন্ত্রে বিভিন্ন মত ও একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়। দেশের শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে; সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনা ও জনমত গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। একনায়কতন্ত্রে একটি দলের অস্তিত্ব বা ব্যক্তি বিশেষের প্রাধান্যকে স্বীকার করা হয়। ফলে নায়ক ও তার দলের স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।