গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি | Definition and Nature of Democracy
■ প্রশ্ন:- গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের প্রকৃতি আলোচনা করো। (Definition and Nature of Democracy).
■ উত্তর:- গণতন্ত্রের বিভিন্ন অর্থ ও রূপ:- রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সরকারের বিভিন্ন রূপ আলোচনা প্রসঙ্গেই গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা’ হল গণতন্ত্রের সংকীর্ণ অর্থ। ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র শাসনব্যবস্থার ধারণার নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে এক মহৎ আদর্শে পরিণত হয়েছে। বর্তমান কালে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির দ্বারা এক বিশেষ সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা এমনকি এক বিশেষ অর্থ – ব্যবস্থাকেও বোঝান হয়। তবে গণতন্ত্রের অর্থ যা হোক, সাম্য হল এর মূল ভিত্তি। সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য, রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে = সাম্য বর্তমান থাকলে যথাক্রমে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয়।
■ বার্নস -এর মতে, ‘আদর্শগত বিচারে গণতন্ত্র হল এমন এক সমাজব্যবস্থা যেখানে সকল ব্যক্তি একই রকম না হলেও সকলেই সমান। অর্থাৎ প্রত্যেকেই সমাজের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ।
■ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র:- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বোঝায় যা সাম্যনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনৈতিক সাম্য বর্তমান থাকে। জাতি-ধর্ম, স্ত্রী পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রত্যেকে সমান রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করে।
এর ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনসাধারণের হাতেই চূড়ান্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ন্যস্ত থাকে। জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার চূড়ান্ত অধিকারী বলে গণ্য হয়। মিল ‘রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতায় সকলের প্রবেশাধিকার হল গণতন্ত্র’।
■ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা:- গণতান্ত্রিক সরকার বা শাসনব্যবস্থা হল গণতন্ত্রের সংকীর্ণ অর্থ। এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রবক্তারা গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে বোঝায় জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে। তবে জনগণের দ্বারা সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাই হল গণতান্ত্রিক সরকারের প্রকৃত বা আদি রূপ।
প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের ক্ষুদ্রাকৃতির নগর-রাষ্ট্রগুলিতে এ ধরনের প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বর্তমান ছিল। বর্তমানকালে অধিকাংশ রাষ্ট্রের আয়তন ও লোকসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিনিধিমূলক পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা সম্ভব নয় । কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবেই এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।
■ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা:- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে পার্থক্য আছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সর্বময় কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকলেও শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত নাও থাকতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে কোন রাজা বা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মুষ্টিমেয়, প্রতিনিধিগণ দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন। দৃষ্টান্ত হিসাবে ইংল্যান্ডের কথা বলা যায়।
ইংল্যান্ডে জনগণই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং ইংল্যান্ড হল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; কিন্তু শাসনব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক। কারণ শাসনব্যবস্থার শীর্ষে অধিষ্ঠিত থাকেন একজন রাজা বা রানী। অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের দ্বারাই শাসনকার্য পরিচালিত হয়। তবে বর্তমান বৃহদায়তন এবং জনবহুল রাষ্ট্রে জনগণের প্রত্যক্ষ শাসনের পরিবর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত কেবল ‘জনগণের শাসন’ নয়, গণতান্ত্রিক সরকারের ‘জনগণের দ্বারা শাসন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
■ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র:- সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেন। সমাজ থেকে যাবতীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের বিলোপ সাধন করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শের সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। গণতান্ত্রিক আদর্শকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বা কাঠামোতে সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে যে সকল বিষয়ের কথা বলা হয় সেগুলি হল:
উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সামাজিক মালিকানা, সর্বসাধারণের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, মুনাফা অর্জনের পরিবর্তে জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্য উৎপাদন পরিচালনা, সকল রকম শোষণের অবসান, শিল্প পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রভৃতি । অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে, ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন।’
■ গণতান্ত্রিক জীবনাদর্শ:- আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকের কাছে গণতন্ত্র কেবলমাত্র একটি সামাজিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক আদর্শ বা রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়; এ হল একটি জীবনধারা বা জীবন-যাপন পদ্ধতি (way of life)। গণতান্ত্রিক জীবনধারা বলতে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণকে বোঝায়। গণতান্ত্রিক জীবন-যাপনের ভিত্তি হিসাবে গণতান্ত্রিক আদর্শের উপর আস্থা, পারস্পরিক মত বিনিময় ও আলাপ-আলোচনার উপর নির্ভরশীলতা, যে-কোন রকম বৈষম্য ও অন্যায়ের প্রতিবাদ, অপরের প্রতি সম্মানজনক আচরণ প্রভৃতির কথা বলা হয়। বলা হয় যে জীবন-যাপনের এই পদ্ধতি সকলে অনুসরণ করলে প্রত্যেকের স্বাভাবিক ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব হবে।
● ম্যাক্সি বলেছেন:- গণতান্ত্রিক জীবনধারায় পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, বলপ্রয়োগকে একেবারে অস্বীকার করা হয়।