বাংলা নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান | Dwijendralal Roy’s Contribution Bengali Drama
❏ প্রশ্ন:- বাংলা নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো। (Dwijendralal Roy’s Contribution Bengali Drama)
উত্তর:- ■ ভূমিকা : বাংলা নাট্যজগৎকে যারা অসামান্য প্রতিভায় সমৃদ্ধ ও পুষ্ট করেছেন, তাদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা রঙ্গমঞ্চে ঐতিহাসিক নাটক উপস্থাপনায় তিনি নতুন জোয়ার এনে দিয়েছিলেন। কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য তিনি লণ্ডন গিয়েছিলেন।
সেখানে ইংরাজী নাটকের অভিনয় দেখে তিনি নাট্যকলা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ইংলণ্ডে বাসকালে তিনি ইংরাজী নাট্যাভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিলাত থেকে ফিরে এসে বাংলা নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত হন। প্রথমে প্রহসন রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা নাট্যজগতে আবির্ভূত হন।
এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “বিলাত যাইবার পূর্বে আমি ‘হেমলতা’, ও নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় দেখিয়াছিলাম মাত্র, আর কৃষ্ণনগরের এক সৌখিন অভিনেতৃদল কর্তৃক অভিনীত ‘সধবার একাদশী’ ও ‘গ্রন্থকার’ নামক একখানি প্রহসন দেখি; আর Addision- এর Cato এবং Shakespeare -এর Julias Caeser এর আংশিক অভিনয় দেখি। সেই সময় হইতেই অভিনয় ব্যাপারটিতে আমার আসক্তি হয়।”
■ প্রথম রচনা প্রহসন:- দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন মজলিশী কৌতুকপ্রিয় মানুষ। জীবনকে তিনি হাস্যরসিকের দৃষ্টি নিয়ে দেখেছিলেন বলে তিনি প্রথমে প্রহসন রচনায় আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম প্রহসন ‘কল্কি অবতার’ (১৮৮৫)। এর মধ্যে তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রুপের কশাঘাত করেছেন নব্য হিন্দু, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, গোঁড়া হিন্দু, ব্রাহ্ম ও বিলেত ফেরত দলকে।
১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে রচনা করেন ‘বিরহ’। এটি বিশুদ্ধ প্রহসন। ‘এ্যহস্পর্শ’ (১৯০০) ও ‘প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০২) —এই দুটি প্রহসন নির্মল হাস্যরসের উপাদানে পূর্ণ। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়, ‘পুনর্জন্ম’ (১৯১৯)। এই সকল প্রহসনে তিনি যে সকল হাসির গান পরিবেশন করেছেন, সেগুলি এদের মূল আকর্ষণ। এদের মধ্যে গভীরতর জীবনবোধ ও শিল্পনৈপুণ্যের অভাব।
■ পৌরাণিক নাটক : দ্বিজেন্দ্রলাল যে যুগে নাটক রচনা করেন, সে যুগে কাব্যে পৌরাণিক বিষয়কে আধুনিক ভাবনার আলোকে প্রকাশ করবার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। নাটকেও এই ধরনের মনোভাব দেখা দিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলালও বিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদের আলোকে পৌরাণিক বিষয়বস্তুকে ব্যাখ্যা করে পৌরাণিক নাটক রচনা করলেন। এগুলি হল : ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯১৪)। এই পৌরাণিক নাটক রচনায় তাঁর প্রতিভার সম্যক পরিচয় প্রকাশ পায়নি। কেননা পৌরাণিক নাটকের ধূল আশ্রয় যে ভক্তিরস, তা এই সকল পৌরাণিক নাটকে নেই। আধুনিক যুগের ভাবাদর্শে সীতা চরিত্রকে চিত্রিত করার ফলে তার লেখা ‘সীতা’ নাটক সার্থক হয়নি।
■ নাট্যপ্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব ঐতিহাসিক নাটক: দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখা ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে। বস্তুর তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য সম্পদ। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায়, সংলাপের আলংকারিক প্রয়োগে, চরিত্রায়নের গভীরতায় ও দ্বন্দ্বসংঘাতে দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলি আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বাংলা নাটকে ইতিহাস-রসের এমন সার্থক প্রয়াস আর কোন নাট্যকারই করতে পারেননি। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “১৯০৫ সালের স্বাদেশিক উত্তেজনাপূর্ণ আত্মত্যাগের পটভূমিকায় দ্বিজেন্দ্রলাল এই বীর রসাত্মক উদ্দীপনাসঞ্চারকারী আদর্শবাদের অপূর্ব নাটক রচনা করে বাংলা সাহিত্যের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন, নিজের নাট্যপ্রতিভার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন এবং গিরীশচন্দ্রের সুলভ ভক্তিরসাত্মক পৌরাণিক নাটকের স্থলে রণবঙ্গমুখর ইতিহাসকে রঙ্গমঞ্চে টেনে এনে নাটকের ক্ষেত্রে একপ্রকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন।”
■ দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটক: ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩), ‘প্রতাপ-সিংহ’ (১৯০৫), ‘নূরজাহান’ (১৯০৮), ‘মেবার পতন’ (১৯০৮), ‘সাজাহান’ (১৯০৯), ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১), ‘সিংহলবিজয়’ (১৯১৫)। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রধান কৃতিত্ব, তিনি ঐতিহাসিক নাটকে যথার্থ ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলেছেন, ইতিহাসকে কোথাও বিকৃত করেননি।
নাটকের প্রয়োজনে যে সকল কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যেও ঐতিহাসিক ভাবনা সুন্দররূপে রূপায়িত হয়েছে। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির মধ্যে অদ্ভুত কৌশল, মানসিক, দ্বন্দ্বসংঘাত সৃষ্টি করে নাট্যকাহিনীকে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। “নূরজাহানের ক্ষমতালাভের সঙ্গে নারীহৃদয়ের দ্বন্দ্ব, সাজাহানের পিতৃসত্তা ও সম্রাটসত্তার বিরোধ, পরিশেষে পিতৃসত্তার জয়লাভ, ‘চন্দ্রগুপ্ত’ চাণক্য চরিত্রের উদয় ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নাট্যকার অতি চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন।”
■ বৃহত্তর জীবনাদর্শ:- দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকের সাফল্যের আর একটি কারণ হল — এইসব নাটকে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি বৃহত্তর জীবনদর্শের জয়গান গাওয়া হয়েছে। সাজাহানের মধ্যে দেখানো হয়েছে সম্রাটসত্তার উপরে পিতৃসত্তার জয়, ‘মেবার পতনে’ দেখানো হয়েছে সামগ্রিক কল্যাণনীতি ও জাতীয় ঐক্য, ‘চন্দ্ৰগুপ্তে’ দেখান হয়েছে কুটবুদ্ধিসম্পন্ন চাণক্যের মর্মস্পর্শী পিতৃস্নেহ।
এছাড়া তাঁর মতো ভাষার মাধুর্য, আলংকারিক সংলাপ, চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্য, দৃশ্য সমাবেশের কৌশল, ঘটনা পরম্পরার দ্রুততা, সঙ্গীতে নতুন ধরনের রাগ-রাগিনীর সন্নিবেশ, ঘটনাবলীর কেন্দ্রানুবর্তিতা, রুচির বিশুদ্ধতা এবং সামগ্রিকভাবে ইতিহাস রস পরিস্ফুটন অন্য কোন নাট্যকারের নাটকেই দেখতে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে তাঁর চরিত্রগুলির নাট্যসংলাপের কোন তুলনা নেই। দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটক বাংলা সাহিত্যের মহামূল্যবান সম্পদ।
■ সামাজিক ও পারিবারিক নাটক:- দ্বিজেন্দ্রলাল দুটি সামাজিক ও পারিবারিক নাটক রচনা করেছেন — ‘পরপারে’ (১৯১২) ও ‘বঙ্গনারী’ (১৯১৬)। এই দুটি নাটকে সত্যিকার সমাজ সমস্যা বিশেষ কিছু নেই। অহেতুক হত্যা, সংঘাত ও আকস্মিক ঘটনার দ্বারা নাটকীয়তা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে।
■ উপসংহার:- দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাট্যধারাকে নানাভাবে রসপুষ্ট করেছেন। আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তিনি আধুনিকতার প্রবর্তক। আধ্যাত্মিকতা ও আলৌকিকতা বর্জন করে তিনি নাটকে আধুনিক জীবন ভাবনা নিয়ে এসেছেন। চরিত্রের ঘাতপ্রতিঘাতময় অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশে তিনি দেখিয়েছেন অসাধারণ কৃতিত্ব। সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে তিনি এনে দিয়েছিলেন এমন এক অপূর্ব আলংকারিক ঝংকার যা অদ্যাবধি কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সংগীত রচনায় তিনি অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন।