বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান | Parichand Mitra’s Contribution Bengali Novel Literature
❏ প্রশ্ন:- বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো?
উত্তরঃ- প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩) বাংলা গদ্যসাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় নাম। বাংলা গদ্য ভাষার সৃজনযুগে তিনি চলিত ভাষায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাস রচনা করে গদ্য ভাষায় ও সাহিত্যে নবযুগের সূচনা করেন। বাংলা গদ্য সাহিত্যের সেই সৃজনপর্বে একদিকে ছিলেন বিদ্যাসাগর ও অন্যদিকে প্যারীচাঁদ মিত্র। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতবৃন্দ ও রামমোহন বাংলা গদ্য ভাষার কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। বিদ্যাসাগর ১৮৬০ সালে প্রচলিত ‘শকুন্তলা’ ও ‘সীতার বনবাস’ গদ্যগ্রন্থে সাধুভাষার একটি সুনির্দিষ্ট রূপাবয়ব নির্মাণ করলেন।
কিন্তু তারও কিছু আগে প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা চলিত গদ্যে উপন্যাস রচনা করে যে অসামান্য দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। বিদ্যাসাগরের গদ্য ভাষা অলংকার ও কলাকৌশলপূর্ণ ছিল। কিন্তু ঐ ভাষায় জীবনের বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভবপর ছিল না। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্র — ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ এই ছদ্মনামে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামে একখানা উপন্যাস রচনা করে বাস্তব জীবনকে সর্বপ্রথম পাঠকের সামলে তুলে ধরলেন। টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আললের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থখানি প্রকৃতপক্ষে বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত গুরু গম্ভীর গদ্য ভাষার একটা প্রতিক্রিয়া।
প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত উপন্যাস ও অন্য রচনাগুলি হল : ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) ‘মদ খাওয়া বড় দায়’, ‘জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯), ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬০), ‘যৎ কিঞ্চিৎ (১৮৬৫), ‘অভেদী’ (১৮৭১), ‘আধ্যাত্মিকা’ (১৮৮০)। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সামাজিক উপন্যাস। উপন্যাসের চেয়ে এর মধ্যে নকশা-ধর্মই প্রধান। এযি বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাংলা উপন্যাস যার মধ্যে আছে মতিলাল নামক একজন ধনী সন্তানের অধঃপতন ও পুনরায় সুমতি ফিরে পাবার কাহিনী। এই কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখক এর মধ্যে তৎকালীন সমাজ জীবনের খণ্ড খণ্ড পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। এই খণ্ড চিত্রগুলি এই উপন্যাসের প্রথম আকর্ষণীয় বিষয়। এদের মধ্য দিয়েই সেখানের জীবনযাত্রার বাস্তব পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিশেষ কোন Plot বা ঘাত প্রতিঘাত ও দ্বন্দ্বের অভাবে এর কাহিনী দানা বাঁধতে পারেনি।
এই উপন্যাসে রামবাবু, ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম ও মতিলাল বিশিষ্ট চরিত্র। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ – এর ভাষা চলিত ভাষা। লেখক এই গ্রন্থে কলিকাতায় প্রচলিত কথ্য ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। এতে চলিত, দেশী এবং বিদেশী শব্দেরই প্রাধান্য। ক্রিয়াপদও প্রায় সবই কথ্য ভাষায়। তাই এই বইয়ের ভাষা শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলেরই সহজবোধ্য। আলালের ঘরের দুলালের’ ভাষায় এইটিই প্রধান বিশেষত্ব। টেকচাঁদ যে কোনও শব্দের মধ্যে একটু সাধুরূপের গন্ধ পেয়েছেন, সেটি বর্জন করেছেন। তিনি প্রয়োজনমত প্রচলিত ও অপ্রচলিত দেশী ও তদ্ভব শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভাষা যাতে সর্বজন-বোধগম্য হয়, তার চেষ্টা করতে তিনি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেননি।
পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ লেখকদের রচনার উপর আলালী ভাষার প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণেই পড়েছিল৷ বঙ্কিমচন্দ্র প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রশংসায় লিখেছেন— “দুইটি গুরুতর বিপদ্ হইতে প্যারীচাঁদ বাঙ্গালা সাহিত্যকে উদ্ধার করেন। যে ভাষা সকল বাঙ্গালীর বোধগম্য এবং সকল বাঙ্গালী কর্তৃক ব্যবহৃত, তাহাতে প্রথম তিনি গ্রন্থপ্রণয়নে ব্যবহার করিলেন এবং তিনিই প্রথম সংস্কৃত ও ইংরাজী ভাণ্ডারের পূর্বগামী লেখকদিগের উচ্ছিষ্টাবশেষ অনুসন্ধান না করিয়া স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হইতে আপনার রচনার উপাদান সংগ্রহ করিলেন।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামক গ্রন্থে উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল।” “তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে। তাহার জন্য সংস্কৃত ও ইংরাজীর কাছে ভিক্ষা করিতে হয় না। তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, যেমন জীবনে তেমনি সাহিত্যে ঘরের সামগ্রী যত সুন্দর পরের সামগ্রী তত সুন্দর বোধ হয় না। তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, যদি সাহিত্যের দ্বারা বাংলা দেশকে উন্নত করিতে হয়, তবে বাংলা দেশের সাহিত্য লইয়াই সাহিত্য গড়িতে হইবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের আদি ‘আলালের ঘরের দুলাল”।
❏ অন্যান্য গ্রন্থঃ- “মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়” ও “রামারঞ্জিকা” প্যারীচাঁদ মিত্রের অপর দুইটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এগুলির মধ্যে সমাজের বিভিন্ন চিত্র খণ্ড খণ্ড আকারে পরিবেশিত হয়েছে। এদের মধ্যে উপন্যাসের কোন গুণ নেই। গোঁড়া হিন্দু সমাজের মদ্যপায়ী ও পরস্বাপহারী পাষগুদের ছবি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ‘রামারঞ্জিকা’ নারীপাঠ্য গ্রন্থ। এতে দেশবিদেশের বিশিষ্ট নারীর চিত্র আঁকা হয়েছে। ‘অভেদী’ রূপকধর্মী উপন্যাস।