বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান | Bibhutibhushan Banerjee’s Contribution Novels and Bengali Short Stories

বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান | Bibhutibhushan Banerjee’s Contribution Novels and Bengali Short Stories

প্রশ্ন:- বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর (Bibhutibhushan Banerjee’s Contribution Novels and Bengali Short Stories)।

উত্তর:- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আপন প্রতিভার স্বাতন্ত্র্যে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে নতুনত্ব নিয়ে এসেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যে দেখা দিয়েছিল অবক্ষয়, নৈরাশ্যবাদ, শ্রমজীবী জাগরণ, ধনতন্ত্রের উত্থান প্রভৃতি বিষয়। কল্লোল যুগের সাহিত্যিকরা যখন সাহিত্যে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে এনে দিলেন গ্রাম বাংলার শান্ত স্নিগ্ধ রূপবৈচিত্র্য।

বাংলার গ্রামকে তিনি আপন প্রাকৃতিক রূপেই প্রকাশ করলেন, বাংলার দরিদ্র মানুষের সহজ সরল জীবনচিত্র গভীর আন্তরিকতায় ফুটিয়ে তুললেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যপাঠে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, “তোমার সাহিত্য দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।” বিভূতিভূষণের উপন্যাসগুলির মধ্যে প্রকৃতির ভূমিকা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পে মানুষ ও প্রকৃতি এক সুরে বাঁধা।

তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে সহজ সরল মানবজীবন ও প্রকৃতির রূপ বর্ণিত। উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৩৫), ‘দৃষ্টি প্রদীপ’ (১৩৪২), ‘আরণ্যক’ (১৩৪৫), আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৩৪৭) ‘দেবযান’ (১৩৫১), ইছামতী’ (১৩৫৬) প্রভৃতি। প্রকৃতির সৌন্দর্যচেতনার আনন্দময় বোধে, ও মননে, উদার সহৃদয়তার তাঁর সাহিত্য চিরন্তন জীবনের পরম আশ্বাসের এক শাশ্বত বাণী। জীবনের এই আনন্দরসে আপন স্বাতন্ত্র্যে বিভূতিভূষণ ছিলেন সে যুগে একক, দোসরহীন।

জীবনপথের চিরপথিক, চিরশিশু বিভূতিভূষণের রচনাশৈলীও ছিল শিশুর মতই সরল— নিরাবরণ, নিরাভরণও। বিভূতিভূষণের সাহিত্যপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয় রয়েছে পথের পাঁচালী উপন্যাসে। গ্রাম বাংলার পটভূমিতে হরিহর সর্বজয়া অপু দুর্গা প্রভৃতি চরিত্রের সমাবেশে এক অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতি এর মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিভূতিভূষণ এখানে প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘পথের পাঁচালী’ র পরিপূরক উপন্যাস ‘অপরাজিত”। বিভূতিভূষণের অপর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘আরণ্যক’ — এখানে পার্বত্য প্রকৃতির ভয়াল ভয়ংকর রূপ চিত্রিত হয়েছে। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে বিহারের লবটুলিয়া অঞ্চলের অরণ্য প্রকৃতির বাস্তব জীবন পরিবেশ। অরণ্য প্রকৃতি এই উপন্যাসে নায়ক। বস্তুতঃ এই ধরনের উপন্যাস অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়নি। পল্লীবাংলার মধুর সম্পর্কস্নিগ্ধ পরিবারকেন্দ্রিক সমাজজীবনই প্রধানতঃ ছিল তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের জগৎ।

সেই সঙ্গে তার ছিল চিরশিশুর সারল্যে পরলোক চিন্তা ও রহস্যময় তন্ত্রাচারের প্রতি অসীম কৌতূহল। এই চিন্তা ও চেতনার অভিনব রূপায়ণ পাওয়া যায় তাঁর ‘দেবযান’ উপন্যাসে। বিভূতিভূষণের অধিকাংশ ছোটগল্প বাংলার গ্রামজীবন কেন্দ্রিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলার ছোটগল্পে জীবনের যে দ্বন্দ্ব জটিলতা যৌনতার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, বিভূতিভূষণের গল্পে তার প্রভাব পড়েনি । বাংলার পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সুখদুখ আনন্দ বেদনাকে তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই ছোটগল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তার ছোটগল্পগুলির মধ্যেও মানবজীবন ও প্রকৃতি এক সূত্রে বাঁধা আছে।

বিভূতিভূষণের ছোটগল্পের গ্রন্থগুলি হল— “মেঘমল্লার’ ‘উপলখণ্ড’, ‘মুখোস ও মুখশ্রী’ প্রভৃতি। বিভূতিভূষণের গল্পের বৈচিত্র্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পল্লীজীবনের চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি তন্ত্র সম্পর্কিত কতকগুলি গল্পও লিখেছেন যার মধ্যে আছে’ তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’। তান্ত্রিকের মন্ত্র উচ্চারণে সুন্দরীর বেশে আবির্ভূত হয় এক যোগিনীমূর্তি। ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে — সহাস্যনয়নী হতে ভ্রূকুটিকুটিলা, প্রেমময়ী হতে জিঘাংসাময়ী। আচরণেও পাই উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে নীরবতা। রহস্যঘন পরিবেশে এই অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড আমাদের বুদ্ধিকে করে বিমূঢ়, বোধকে করে বিস্মিত, দেহ মন – প্রাণ করে রোমাঞ্চিত। আমরা এক অলৌকিক জগতের কল্পলোকে মায়াবিষ্টের মত উত্তীর্ণ হই।

অলৌকিক অস্তিত্বের বিশ্বাসজনিত ক্রিয়াকলাপের এক রহস্যময় পরিবেশের মাদকতার আবেদনই বিভূতিভূষণের এই শ্রেণীর গল্পের প্রাণরস। শিশু সুলভ সারল্যে রোমান্টিক স্বপ্নবিভোর দৃষ্টিতে বিভূতিভূষণ দুচোখ মেলে তা দেখেছেন। প্রথম জীবনে কিছুদিন বিভূতিভূষণ ‘গো – রক্ষণী সভা’ – প্রচারকের চাকুরী করেন। সেই জীবনের অভিজ্ঞতার একটি স্ফুলিঙ্গ শিল্পীর মর্মবেদনায় রস – রূপ লাভ করেছে তাঁর পশুপ্রেমের গল্পরূপে ‘বুধীর বাড়ী ফেরা’ গল্পে। কসাইখানা থেকে কোনক্রমে পালিয়ে বেঁচে বাড়ী ফিরে আসে ‘বুধী’ নামে একটি গাভী। মৃত্যু ভীতির গণ্ডী পেরিয়ে উদার মুক্ত প্রান্তরে পৌঁছে তাঁর অন্তরের যে উত্তেজনাপূর্ণ আনন্দ অনুভূতি, তাঁকে বিভূতিভূষণ আপন অন্তরের মর্মবেদনায় মনুষ্যসুলভ উপলব্ধিতে উপভোগ্য করে তুলছেন।

বাংলা সাহিত্যে পশুপ্রেমের গল্প হিসাবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’, শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের পাশে বিভূতিভূষণের ‘বুধীর বাড়ী ফেরা’ এক অনবদ্য স্মারকমালা। বিভূতিভূষণের জীবন ও জগৎ ছিল প্রকৃতিময় — তাঁর মননে, বোধে, জীবনে এবং সাহিত্যেও। পথের পাঁচালী ও অপরাজিতা – র অপু, আরণ্যকের সত্যচরণ, প্রথম ছোট গল্প ‘উপেক্ষিতার’ বিমল প্রমুখ চরিত্র এক একটি নব নব রূপের স্বয়ংপ্রকাশ।

প্রকৃতিচেতনার প্রাণরসে সঞ্জীবিত এই আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শুচিশুভ্রতায় বিভূতিভূষণের সাহিত্য, যেন ছিল বিশ্বজীবনের আশ্বাসে ভরা‘ আনন্দরূপম্ অমৃতম্ যবিভাতি। বিভূতিভূষণের ছোট গল্পগুলি বাংলা সহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। এদের মধ্যে জীবনের সহজ সরল রূপ গভীর আন্তরিকতার মধ্যে এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে যা মনকে অভিভূত করে।

প্রখ্যাত সমালোচক ড.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, “শিশুর মতো কৌতূহল এবং কবির মতো কল্পনার প্রলেপ দিয়ে বিভূতিভূষণ অননুকরণীয় ভাষায় এমন গ্রামীণ জীবনের চিত্র এঁকেছেন যে চিত্র হিসাবে তা অনবদ্য এবং অনতিক্রমণীয়। দুঃখ দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন, কিন্তু সে ছবি কোনো সমাজ বা অর্থনীতিঘটিত প্রখর -প্রশ্ন উত্থাপন করে না। ”বাংলা ছোটগল্পে বিভূতিভূষণের অবদান তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।