জনগণের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের মূল্যায়ন | Theory of People’s Sovereignty
■ জনগণের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের মূল্যায়ন করো (Theory of People’s Sovereignty)।
উত্তর:: চরম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবেই জনগণের সার্বভৌমিকতা সংক্রান্ত তত্ত্বের সৃষ্টি হয়। রাজতন্ত্র বিরোধী লেখকগণই এই তত্ত্বের মুখ্য প্রবক্তা। সার্বভৌমিকতার প্রকৃত অধিকারী হল জনগণ — এটাই হল এই মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং জনগণের নির্দেশই হল আইন। রাষ্ট্রের এলাকার ভিতরে এই গণশক্তির আর কোন ঊর্ধ্বতন শক্তি নেই। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী থেকে জনগণের সার্বভৌমিকতা বিষয়ে ধারণার সৃষ্টি হয়। মধ্যযুগে মারসিগ্লিও, উইলিয়াম আলথুসিয়াস (Althusius) প্রমুখ লেখক প্রচার করেন যে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। লক প্রচার করেন যে জনগণই চরম ক্ষমতার অধিকারী।
জনগণের ইচ্ছা অনুসারে আইন প্রণীত হয়। শাসক জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে তাদের ইচ্ছা অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। রুশো তাঁর ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ র (General will) মাধ্যমে গণ-সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন: “Voice of the people is the voice of God.” জেফারসনও এই তত্ত্বের দৃঢ় সমর্থক। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রিচি (Ritchie) -র মতানুসারে জনসাধারণের সমষ্টিগত ক্ষমতার তুলনায় বড় ক্ষমতা আর নেই। জনগণের এই সম্মিলিত ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে কোন সরকার টিকে থাকতে পারে না। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে এবং জনমতের চাপ ও বিপ্লব-বিদ্রোহের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে।
❏ সমালোচনা:- বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণ-সার্বভৌমত্বের তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়।
(১) জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। এর কোন বিজ্ঞানসম্মত নির্দিষ্ট অর্থ করা যায় না। সার্বভৌমিকতা জনগণের হলে, ‘জনগণ বলতে ঠিক কি বোঝায় তা পরিষ্কার হয় না।’ গার্ণার বলেছেন : “The term popular sovereignty’ is frequently and generally used by writers in a loose and inexact sense, and when so used it may bad to misconception and even to mischief.”
(২) সাধারণভাবে জনগণ অসংগঠিত। অসংগঠিত জনগণ কখনও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না।
(৩) অনেকের মতে জনগণের সার্বভৌমিকতা বলতে জনমতের ক্ষমতাকেই বোঝায়। কিন্তু জনমত অসংগঠিত ও অনির্দিষ্ট। আইনের দৃষ্টিতে তা সার্বভৌম হতে পারে না। গার্ণার বলেছেন: Unorganised public opinion, however powerful is not sovereignty unless it is clothed in legal form ……”
(৪) এখনকার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভোগ করেন। কার্যক্ষেত্রে তাঁরাই হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এই শ্রেণীর নির্বাচকদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ মাত্র। দেশের জনগণের এক-পঞ্চমাংশের এই ক্ষমতাকে জনগণের সার্বভৌমিকতা বলা যায় না।
(৫) অনেকের মতে জনগণের বিপ্লবের দ্বারা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতাই হল সার্বভৌমিকতা। কিন্তু বিপ্লব আইনসঙ্গত হতে পারে না। অথচ সার্বভৌমিকতার ধারণা হল, আইনগত। তাই জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণাকে গেটেল বলেছেন : “A contradiction in terms.”
❏ মূল্যায়ন:- বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে গণ-সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণ-সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। লর্ড ব্রাইসের মতানুসারে এ হল ‘গণতন্ত্রের ভিত্তি ও মূলমন্ত্র’। এই মতবাদ গণশক্তির বিপুল প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমানে সরকার জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনুগামী হয়। এখন জনমতই হল গণতন্ত্রের ভিত্তি ও প্রাণস্বরূপ। ভোটাধিকার, স্বায়ত্তশাসন, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা এবং গণ-ভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ঘটে। তাই গিলক্রিস্টের অভিমত হল : ‘জনগণের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাই হল জনগণের সার্বভৌমিকতা’। তিনি বলেছেন : “The Phrase popular control ‘ better indicates the idea underlying popular sovereignty.”