সাম্যের সংজ্ঞা, প্রকৃত অর্থ ও ধারণা | Definition Meaning and Concept of Equality

সাম্যের সংজ্ঞা, প্রকৃত অর্থ ও ধারণা | Definition Meaning and Concept of Equality

সাম্যের সংজ্ঞা বা, গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।

সাম্যের সংজ্ঞা:: সাম্য বলতে সমাজে সকলে সব বিষয়ে সমান হবে— একথা বোঝায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য বলতে সমস্ত বিষয়ে সমতা বা অভিন্নতা বোঝায় না। মানুষে মানুষে শক্তি-সামর্থ্য ও বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্য আছে বলে প্রত্যেকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান সুযোগ – সুবিধা বা ব্যবহার দাবি করতে পারে না।

সাম্যের প্রকৃত অর্থ:- সাম্যের প্রকৃত অর্থ হল সকলের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার সমতা। এই অর্থে সাম্য প্রত্যেকের আত্মোপলব্ধির সহায়তা করে। রাষ্ট্র কোন রকম পক্ষপাতিত্ব না করে প্রত্যেক নাগরিককে সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার দিবে, যাতে সকলে ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সমান সুযোগ পায়। অর্থাৎ কারও জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা থাকবে না, তেমনি প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকবে। রাষ্ট্রের কাজে বা আইনের চোখে সকল নাগরিকই সমান সুযোগ পাবে। আইনের চোখে সকল নাগরিকই সমান। এই অর্থে সাম্য একটি আইনগত ধারণা। অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ পাবে।

সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দিলেই প্রত্যেকে সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সমানভাবে ব্যক্তিত্বের উন্নতি করতে পারবে, তা বলা যায় না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোন দায়িত্ব নেই। রাষ্ট্র কেবল সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করবে যাতে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সকলে সমান সুযোগ পাবে। সাম্য বলতে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সকলের সুযোগ-সুবিধার সমতাকে বলা হয়। কিন্তু এর ফলে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে এবং প্রত্যেকে একই রকম গুণগত যোগ্যতা অর্জন করবে তা বোঝায় না। তবে প্রকৃত সাম্য মানুষের আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে।

মার্কসীয় ধারণা:- মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয় যে, ধনবৈষম্যমূলক ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব অসম্ভব। মার্কসবাদীদের মতানুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এবং সাম্য এক সঙ্গে থাকতে পারে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের অবসানের মাধ্যমে সমাজে সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরবিরোধী নয়, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে সাম্য ও স্বাধীনতার ভিতরে পারস্পরিক পরিপূরক সম্পর্কের কথা নিহিত আছে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারাও সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধিতাকে অস্বীকার করেছেন।

কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনৈতিক চিন্তাবিদ্গণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য এবং স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধিতার কথা বলেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা কেবল স্বাধীনতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ পরস্পর বিরোধী — এ হল স্বাধীনতা ও সাম্য সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা বলতে যদি ব্যক্তির খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করার অনিয়ন্ত্রিত ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে বোঝায় তা হলে সাম্যের সঙ্গে এই স্বাধীনতার বিরোধ স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বাধীনতার সঠিক ধারণা নয়; এ হল উচ্ছৃঙ্খলতা বা স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের অত্যুগ্র বাসনার জন্য এই শ্রেণীর চিন্তানায়কগণ সাম্যের আদর্শকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।

সাম্যই প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি:- রুশো, মেইটল্যাও, ল্যাস্কি, বার্কার, টনি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও মার্কসবাদিগণ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক ধারণা। উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক অতি নিবিড়। সাম্যের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব। স্বাধীনতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সাম্যের পরিবেশ প্রয়োজন। আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার স্বীকৃত হলে এবং অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য বিলুপ্ত হলে নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা যথাযথভাবে ভোগ করা সম্ভব হত। সমাজে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা থাকলে স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, প্রতিপত্তি, ভেদাভেদে সমাজজীবনে বৈষম্যমূলক আচরণ স্বাধীনতার অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করে।

❏ শ্রেণীবৈষম্য বা ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত স্বাধীনতার সৃষ্টি ও ভোগ অসম্ভব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চোরাবালির উপর স্বাধীনতার সৌধ নির্মাণ করা যায় না। সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতেই প্রকৃত স্বাধীনতা উপলব্ধি করা যায়।

সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক:- সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা অভিন্ন বললে অত্যুক্তি হয় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বোঝায়, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ বিকাশ সাধন করতে পারে। সাম্য বলতেও প্রকৃতপক্ষে একটি পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সমান সুযোগ পায়। সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়েরই উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক মানুষের আত্মোপলব্ধিতে সহায়তা করা। সমাজব্যবস্থায় এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি হবে যাতে প্রত্যেকে স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে আপন আপন ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সাধন করতে সক্ষম হবে।

সুতরাং সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক; পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ যদি স্বাধীনতা হয়, তা হলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া এই স্বাধীনতা অসম্ভব। বাস্তবে এবং প্রকৃতিগত বিচারে উভয় ধারণাই আইনগত। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে । আবার, রাষ্ট্র স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে আইনের মাধ্যমে সমাজের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিলোপ সাধন করে। মার্কসীয় মতবাদে অর্থনৈতিক সাম্যকে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এই তত্ত্ব অনুসারে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।