সংক্ষিপ্ত টীকা- সমাচার দর্পণ পত্রিকা, বঙ্গদর্শন পত্রিকা | Samachar Darpan Patrika, Bangdarshan Patrika

সমাচার দর্পণ পত্রিকা, বঙ্গদর্শন পত্রিকা | Samachar Darpan Patrika, Bangdarshan Patrika

সমাচার দর্পণ পত্রিকা (Samachar Darpan Patrika) :-

উত্তর:: ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামপুরের মিশনারীগণ ‘সমাচার দর্পণ’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকায় তৎকালীন বাংলার সমাজের ও জীবনের নানা ঘটনা ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

সমাচার দর্পণ:- বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহতাসে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে শ্রীরামপুর মিশন থেকেই প্রকাশিত হতে লাগল সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’। এই পত্রিকায় হিন্দুধর্মের কুৎসামূলক নানা রচনা প্রকাশিত হত কিন্তু একই সঙ্গে তার প্রতিবাদ পত্র ছাপা হত না। এটি বাংলাভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র। সমকালীন বাংলা দেশের ভাষা সাহিত্য শিক্ষা রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে সংবাদ ও আলোচনা এখানে প্রকাশিত হত। ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই পত্রিকা চালু ছিল।

❏ ‘সমাচার দর্পণে’ র ভাষা:- নূতন কেতাব — ইংরেজী বর্ণমালা উচ্চারণ সমেত প্রথম বর্ণাবধি সাত বর্ণ পর্যন্ত বাঙ্গলা ভাষায় তর্জমা হইয়া কলকাতায় ছাপা হইয়াছে। তাহাতে পড়িবার কারণ পাঠ ও গণিত ও নামতা ও ব্যাকরণ ও লিখিবার আদর্শ ও পত্রধারা ও আর্জি ও খত ও টলিনামা ও হিতোপদেশ প্রভৃতি আছে।

বঙ্গদর্শন পত্রিকা:-

উত্তর:: বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার বিশেষ গুরুত্ব আছে। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা। এই পত্রিকার পৃষ্ঠায় বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ কালজয়ী উপন্যাস ও প্রবন্ধ আত্মপ্রকাশ করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র নিজে ছিলেন বঙ্গদর্শনের প্রধান লেখক। অক্ষয় কুমার সরকার, চন্দ্রনাথ বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ সাহিত্যিক ‘বঙ্গদর্শনে’ নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে লিখে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন।

বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত রচনাগুলি তৎকালে জনমানসে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। বাংলা সাহিত্য প্রসারে এই পত্রিকার অবদান অসামান্য। বঙ্গদর্শনের ভাষা— “লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্ত সঞ্চালন। এই মহৎ উদ্দেশ্য হুতোমি ভাষায় কখনো সিদ্ধ হইতে পারে না। হুতোমি ভাষা দরিদ্র। ইহার তত শব্দ ধন নাই, হুতোমি ভাষা নিস্তব্ধ, ইহার তেমন বাঁধন নাই; হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশ্লীল নয়, সেখানে পবিত্রতাশূন্য। হুতোমি ভাষায় কখনও গ্রন্থ প্রণীত হওয়া উচিত নহে। ”বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের ভাষা— “ বর্ষাকাল। বড় দুৰ্দ্দিন। সমস্তদিন বৃষ্টি হইয়াছে। একবারও সূর্যোদয় হয় নাই। আকাশ মেঘে ঢাকা। কাশী যাইবার পাকা রাস্তার ঘুটিঙ্গের উপরে একটু একটু পিছল হইয়াছে। পথে প্রায় লোক নাই — ভিজিয়া ভিজিয়া কে পথ চলে ? একজন মাত্র পথিক যাইতেছিল। পথিকের ব্রহ্মচারীবেশ। গৌরিবরণ বস্ত্র পরা। গলায় রূদ্রাক্ষ — কপালে চন্দনরেখা- জটার আড়ম্বর কিছু নাই, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশ কতক শ্বেতবর্ণ। একহাতে গোলপাতার ছাতা, অপর হাতে তৈজস, ব্রহ্মচারী ভিজিয়া ভিজিয়া চলিয়াছেন।”

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা:-

উত্তর:: ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলা গদ্যের বিকাশে এই পত্রিকার বিশেষ অবদান আছে। এই পত্রিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট মণীষীবৃন্দ প্রবন্ধ লিখতেন। বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নতুন ধারার প্রবর্তক। ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগের সূচনা করল। অক্ষয়কুমার দত্তের নীতিগর্ভ বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানোদ্দীপক প্রবন্ধগুলি এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

এই পত্রিকার লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর , রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ। তৎকালে বহু শিক্ষায়তনে এই পত্রিকাটি শিক্ষণীয় পাঠ্যরূপে নির্দিষ্ট ছিল। ‘তত্ত্ববোধিনী’ র ভাষা— “ভূলোকে, দ্যুলোকে, আকাশে, অন্তরীক্ষে, ঊষাকালের, সন্ধ্যাকালের, শ্রদ্ধাবান, একনিষ্ঠ বীরেরা সেই অপ্রকাশক আনন্দস্বরূপ, অমৃত স্বরূপ, পরমেশ্বরকে সর্ব্বত্র দৃষ্টি করেন। উহার উন্মীলনের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য উদিত হইয়া যখন অচেতন প্রাণিগণকে সচেতন করে; তখন সেই জ্যোতিষ্মান সূর্যের মধ্যে সেই প্রকাশবান্ বরণীয় পুরুষকে তাঁহারা দেখিতে পান। ঊষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্তরাকাশে তাহার আলোক প্রকাশ পায়।”

সবুজপত্র পত্রিকা:-

উত্তর:: ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক নতুন চিন্তাধারা নিয়ে এসেছে। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা। এটি ছিল ভাষা আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের পত্রিকা। এর ভাষা ছিল কথ্য ভাষা, রুচি ছিল নাগরিক। এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যচিন্তায়, ভাষাচর্চায়, মননে, প্রকাশ ভঙ্গীতে, সকল প্রকার অস্পষ্টতা ভাবালুতা বিশ্লেষণ বাহুল্য ক্রিয়াপদের একঘেয়েমি দুর করতে চেয়েছিলেন।

এই পত্রিকায় লিখতেন শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী। আধুনিক গদ্যের প্রসারে এই পত্রিকার অবদান অসামান্য। ‘সবুজপত্রে’ র ভাষা— “উকিল ও কোকিল হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণীর জীব যদিচ উভয়েই বাচাল। এর এককে দিয়ে অপরের কাজ করানো যায় না। তবে কথা হচ্ছে এই যে, যে লঙ্কায় যায় সেই যেমন রাক্ষস হয়ে ওঠে, তেমনি যে আদালতে যায় সেই রাসবিহারী হয়, তা নয়।”